শিক্ষক গ্রেফতারি

খবর দেন কাউন্সিলরই, বলছে কামারহাটি

আদালতে দায়ের করা পুলিশি নথিতে অবশ্য তাঁর নাম নেই। কিন্তু ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের একটি সূত্র বলছে, কামারহাটি পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর স্বপন মণ্ডল-ই বৃহস্পতিবার অনেক রাতে বেলঘরিয়া থানায় ফোন করে জানিয়েছিলেন, ১৫-১৬ টি অচেনা মুখ গঙ্গার ধারে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাঘুরি করছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০৭
Share:

আদালতে দায়ের করা পুলিশি নথিতে অবশ্য তাঁর নাম নেই। কিন্তু ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের একটি সূত্র বলছে, কামারহাটি পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর স্বপন মণ্ডল-ই বৃহস্পতিবার অনেক রাতে বেলঘরিয়া থানায় ফোন করে জানিয়েছিলেন, ১৫-১৬ টি অচেনা মুখ গঙ্গার ধারে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাঘুরি করছে। তার ভিত্তিতেই আট জন শিক্ষককে তড়িঘড়ি ধরে নিয়ে এসে তাঁদের বিরুদ্ধে ডাকাতির উদ্দেশ্যে সশস্ত্র জমায়েত (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৯৯ এবং ৪০২ ধারা)-এর মামলা রুজু করে পুলিশ। বর্তমানে তাঁদের ঠিকানা ব্যারাকপুর সাব-জেল।

Advertisement

তৃণমূলের ওই কাউন্সিলর অবশ্য শনিবার দাবি করেছেন, তিনি কিছুই জানেন না। সবটাই রটনা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘লোকে বলছে, আমি পুলিশকে খবর দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানতাম না। স্থানীয় লোকজনই বিষয়টি আমাকে জানান। তবু আমার নামে কেন মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে জানি না।’’ স্বপনবাবু থানায় ফোন করার কথা স্বীকার না করলেও এ দিন কামারহাটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কার্যত এই তথ্যটাই উঠে এসেছে। পুলিশ যে আট শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে তাঁদের এক জনের বাড়ি হুগলিতে। বাকিরা বসিরহাটের বাসিন্দা। বেলঘরিয়া থানার এই ভূমিকায় ধৃতদের নিজের গ্রামের লোকজন তো বটেই, কামারহাটির বাসিন্দারাও সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। একই সঙ্গে উঠে এসেছে বেশ কিছু প্রশ্নও।

যেমন ধৃতদের পরিচয় জানার পরেও পুলিশ কেন তাঁদের বিরুদ্ধে ডাকাতির উদ্দেশ্যে সশস্ত্র জমায়েত-এর মতো ধারা দিল?

Advertisement

কেন গ্রেফতারের আগে বেলঘরিয়া থানার পুলিশ অভিযুক্তদের বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করল না?

রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘সাধারণ ভাবে দাগি অপরাধীদের ক্ষেত্রে এ সব মানা হয় না। কিন্তু ওই আট জন তো সেই গোত্রে পড়েন না। সমাজে যাঁরা শিক্ষক বলে পরিচিত তাঁদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কেন এত তাড়াহুড়ো করা হল, কেনই বা তাঁদের পরিবারের লোকজনকে থানায় আসার সময়-সুযোগ দেওয়া হল না, কেনই বা যে এলাকা থেকে তাঁদের ধরা হয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হল না— তা নিয়ে সংশয় তো রয়েইছে।’’

ধৃত এক শিক্ষকের ভাই বলেন, ‘‘১৯৮৪ থেকে আমি আড়িয়াদহের পাঠবাড়ির নিউ মল্লিক কলোনির একটি বাড়িতে ভাড়া থাকি। গত ৩ অগস্ট দাদা জানান, তিনি ও তাঁর কয়েক জন সহকর্মী কলকাতায় পরীক্ষা দিতে আসবেন। তার জন্য একটা ঘর ভাড়া লাগবে। সেই শুনে আমি ওই এলাকার বাসিন্দা শশাঙ্ক দাসকে তাঁর বাড়ির একটি ঘর ৪ অগস্ট থেকে ১৭ অগস্ট পর্যন্ত ভাড়া দেওয়ার অনুরোধ জানাই।’’ তিনি জানান, ৪ অগস্ট বিকেলে তাঁর দাদা-সহ ছ’জন শিক্ষক হিঙ্গলগঞ্জ থেকে আড়িয়াদহে আসেন। পরের দিন আসেন আরও চার জন। কিন্তু ভাড়ার ঘরটি ছোট হওয়ায় তিন জন অন্যত্র চলে যান। ৬ অগস্ট দাদা ও তাঁর সহকর্মীরা পরীক্ষাও দিতে গিয়েছিলেন। সন্ধেয় ফিরে এসে নিজেরাই রান্না করে খাওয়াদাওয়া করেন। ধৃত শিক্ষকের ভাই বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ আমি দাদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। পরীক্ষা কেমন হল তা জেনে আধ ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরে আসি। রাতে পাড়ার লোকজন আমাকে জানান, পুলিশ দাদা ও তাঁর সহকর্মীদের ডাকাত সন্দেহে ধরে নিয়ে গিয়েছে।’’

পুলিশ অবশ্য দাবি করেছে, গ্রেফতারের আগে ধৃতেরা কোনও পরিচয়পত্র দেখাতে পারেননি। তাঁদের কথাবার্তাও অসংলগ্ন ছিল। কিন্তু ধৃত শিক্ষকের ভাইয়ের দাবি, ‘‘দাদারা পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড দেখিয়েছিলেন। পুলিশ তা দেখতে চায়নি।’’ শুধু তা-ই নয়, আদালতে দায়ের করা নথিতে পুলিশ বলেছে, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টা নাগাদ আদ্যাপীঠে গঙ্গার ধারে ১৪-১৫ জন ডাকাতির উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছে খবর পেয়ে বেলঘরিয়া থানার পিএসআই (প্রবেশনার সাব ইনস্পেক্টর) সুকান্ত দাস বাহিনী নিয়ে গোটা এলাকা ঘিরে ফেলেন। অভিযুক্তেরা পালানোর চেষ্টা করলে আট জনকে ধরে ফেলে পুলিশ। যদিও আড়িয়াদহের যে এলাকা থেকে আট শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই নিউ মল্লিক কলোনির লোকজন জানিয়েছেন, তাঁরা বৃহস্পতিবার রাতে গঙ্গার ধারে কোনও পুলিশকে দেখেননি। কোনও ছোটাছুটিও চোখে পড়েনি। এমনকী, আড়িয়াদহের যে বাড়ির একটা ঘর কিছু দিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন ওই আট শিক্ষক তার মালকিন শ্বেতা দাস এ দিন বলেন, ‘‘ওঁরা শিক্ষক জেনেই থাকতে দিয়েছিলাম। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১১টা নাগাদ বাড়ির দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ পেয়ে খুলে দেখি অনেক পুলিশ। দরজা খুলতেই তারা ভিতরে ঢুকে আট জনকে ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরের দিন অর্থাৎ ৭ অগস্ট রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ফের তিন গাড়ি পুলিশ আসে।’’

শ্বেতাদেবীর স্বামী শশাঙ্কবাবু বলেন, ‘‘ওই রাতে আমাদের কয়েক জনকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয় পুলিশ। পুলিশের এক জন ভয় দেখিয়ে আমাদের বলেন, ‘জানেন তো সামনেই স্বাধীনতা দিবস। কোথায় কোন জঙ্গি লুকিয়ে আছে কে জানে! আপনারা এটা লিখে দিলে কোনও বিপদে পড়বেন না, বেঁচে যাবেন।’’ শ্বেতাদেবীর অভিযোগ, ‘‘এক জন পুলি‌শ অফিসার আমাকে দিয়ে এক প্রকার জোর করে একটা সাদা কাগজে লিখিয়ে নেন যে ভাড়াটেরা সন্দেহজনক ছিল। তাই পুলিশকে খবর দিয়েছিলাম।’’

স্থানীয় সূত্রে খবর, কাউন্সিলর নিজেই ফোন করে থানায় খবর দিয়েছিলেন। আবার পুলিশ ‘স্থানীয় সূত্রে খবর মিলেছে’ বলে আদালতকে জানিয়েছে। তা হলে বেলঘরিয়া থানার পুলিশ সেখানে কেন বাড়ির মালকিনকে দিয়ে সাদা কাগজে জোর করে লিখিয়ে নিল যে তিনি-ই পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন?

ব্যারাকপুর কমিশনারেট অবশ্য এই অভিযোগ স্বীকার করেনি। তবে বিষয়টি যে ‘সাপের ছুঁচো গেলা’ হয়ে গিয়েছে তা এ দিন ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন কমিশনারেটের একাধিক পুলিশকর্তা। এমনকী, নিজেদের ‘কর্মকাণ্ড’ ঢাকতে বারবার ঢোক গিলতেও হচ্ছে তাঁদের।

যেমন শুক্রবার রাতে পুলিশ প্রথমে গ্রেফতারের ঘটনা স্বীকারই করতে চায়নি। রাতে পুলিশ কমিশনার নীরজকুমার সিংহ বলেছিলেন, ‘‘কাদের কেন গ্রেফতার করা হয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’ আর সেই পুলিশ কমিশনারই শনিবার দুপুরে বলেন, ‘‘সন্দেহজনক ভাবে কিছু লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখেই পুলিশ তাদের ডাকাতির উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে। ওঁরা যে শিক্ষক তার প্রমাণ পেলে আমরা অবশ্যই বিষয়টি আদালতকে জানাব।’’

এ দিন দুপুরে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ আনা খুবই বিস্ময়ের। পুরো বিষয়টি ভাল করে খতিয়ে দেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে পুলিশকে।’’ তারই কয়েক ঘণ্টা পরে রাত ৯টা নাগাদ পুলিশ কমিশনার জানান, ধৃতেরা যে পেশায় শিক্ষক তা জানা গিয়েছে। এই তথ্য আদালতকে জানানো হবে।

একই সঙ্গে কোন পরিস্থিতিতে সেই রাতে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাতে কার কী ভূমিকা ছিল তা এসিপি স্বপন হালদারকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার। কিন্তু এ সব তথ্য জানতে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কেন ৪৮ ঘণ্টা লাগল, কেন সব তথ্য যাচাই করে ওই আট জনকে গ্রেফতার করা হল না, তার সদুত্তর মেলেনি।

সিপিএম প্রভাবিত নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি-র সাধারণ সম্পাদক উৎপল রায় বলেন, ‘‘আড়িয়াদহের ঘটনা প্রমাণ করেছে পুলিশ কোথাও অতি সক্রিয়, কোথাও নিষ্ক্রিয়। কখনও শিক্ষকদের মারধর করে পার পেয়ে যায় অভিযুক্তেরা। কখনও বা শুধুই সন্দেহবশে পুলিশ গ্রেফতার করে শিক্ষকদের।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement