জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। জল ঢেলে তাপ কমানোর চেষ্টা। সোমবার বিসি রায় হাসপাতালে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
অ্যাডিনো-সহ অন্য ভাইরাসের আক্রমণে রাজ্যে শিশুমৃত্যু অব্যাহত। জ্বর-শ্বাসকষ্টের উপসর্গ নিয়ে অসুখে ভুগে রবিবার রাত থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে আট জন শিশুর মৃত্যু হল। এর মধ্যে ৫ জন চিকিৎসাধীন ছিল বিসি রায় শিশু হাসপাতালে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এক জন এবং ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এ দু’জন। মৃত শিশুদের মধ্যে তিন জন অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত ছিল।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের সমস্ত সরকারি মেডিক্যাল কলেজ এবং অন্যান্য স্তরের হাসপাতালের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সুপার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ও ডেপুটি সুপার, শিশুরোগ ও ক্রিটিক্যাল কেয়ারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, শিশুদের ‘অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন’ (এআরআই)-এর চিকিৎসা পরিষেবায় যুক্ত কর্মী, জেলার মুখ্য, উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের ছুটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাতিলের নির্দেশিকা জারি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। বেসরকারি সূত্রের খবর, গত ১ জানুয়ারি থেকে এ দিন পর্যন্ত রাজ্যে ‘এআরআই’ বা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে মৃত শিশুর সংখ্যা ১০৩ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত ছিল। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এখন করোনা-আক্রান্তের খোঁজ কার্যত নেই বললেই চলে। ফলে কোভিড বিধি মানারও বালাই নেই। কিন্তু এখন যে ভাবে একের পর এক শিশু ভাইরাসের আক্রমণে কাবু হচ্ছে, তাতে মাস্ক পরা-সহ পুরনো অভ্যাস ফিরিয়ে আনার কথাই মনে করাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। চিকিৎসকেরাও জানাচ্ছেন, বড়দের থেকেই সংক্রমিত হচ্ছে শিশুরা। কারও কারও অবস্থা এতটাই সঙ্কটজনক হয়ে পড়ছে যে, শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে সচেতনতা ও সতর্কতার উপরেই বেশি জোর দিতে বলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এ দিন বিধানসভার অধিবেশনে অ্যাডিনোভাইরাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এখন আবার কিছু দিন মাস্ক পরা উচিত। বড়রা পরলে বাচ্চারা দেখে পরবে। বাচ্চাদের জ্বর, সর্দি, কাশি হলে ডাক্তার দেখাতে হবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সব রাজ্যেই হয়েছে। (খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেল) মা-বাবার চোখের জল দেখিয়ে, মানুষকে আতঙ্কিত করবেন না। রাজ্যে এখনও পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জনের কো-মর্বিডিটি ছিল। কারও কম ওজন ছিল। কারও হৃদ্যন্ত্রে, কারও ফুসফুসে সমস্যা থাকে। আমার বাড়িতেও একটি বাচ্চার অ্যাডিনোভাইরাস জনিত অসুস্থতা হয়েছে।’’ অযথা রেফার না করার বিষয়েও চিকিৎসকদের বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মতে, দূর থেকে বাচ্চাগুলিকে শহরে রেফার করা হচ্ছে। রাস্তায় আসার পথের ধকল সহ্য করতে না পেরে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।
স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশমতো ইতিমধ্যেই অযথা রেফারের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে জেলাস্তরে। যদিও শহরের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অনেক শিশুই বেশ কয়েক দিন পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ারে (পিকু) থাকার পরে মারা যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে, আনন্দপুরের বাসিন্দা আট মাসের এক শিশুপুত্র গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ভর্তি ছিল বি সি রায় হাসপাতালে। প্রথমে পিকুতে রাখা হলেও পরে সাধারণ শয্যায় দেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থা ফের সঙ্কটজনক হওয়ায় তাকে পিকুতে স্থানান্তরিত করা হয়। এ দিন ভোরে তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়াও, গাইঘাটার এক মাসের শিশুপুত্র, বনগাঁর চার মাসের শিশুপুত্রের এ দিন সকালে বি সি রায় হাসপাতালে মৃত্যু হয়। অন্য দিকে গত রাতে এবং এ দিন দুপুরে আরও দুটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে ওই হাসপাতালেই। আবার, রবিবার গভীর রাতে রিজেন্ট পার্কের বাসিন্দা ১০ মাস বয়সি শিশু এবং এ দিন রাতে জয়নগরের ১১ মাসের শিশু মারা গিয়েছে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এ। রবিবার গভীর রাতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যু হয়েছে হুগলির বাসিন্দা এক শিশুর।
চিকিৎসকেরা বারবার জানাচ্ছেন, গরম পড়তে শুরু করায় সংক্রমণের মাত্রা কমছে ঠিকই। কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে বড়দেরই। তা না হলে, বাচ্চাদের সংক্রমণের হাত থেকে পুরোপুরি রক্ষা করা সম্ভব নয়।