ট্রেন চলতেই বেরিয়ে পড়েছে তাস। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
বনগাঁ থেকে রোজ সকালে দমদম ক্যান্টনমেন্টে যান শিক্ষক কৃষ্ণেন্দু পালিত। নানা অভিজ্ঞতার সাক্ষী তিনি। বললেন, “বনগাঁ থেকে যাঁরা ট্রেনে বসে যান, তাঁরা কিছুটা স্বস্তিতে যেতে পারেন। কিন্তু মছলন্দপুরের পর থেকে যাঁরা ওঠেন, সমস্যাটা তাঁদেরই বেশি।” তাঁর অভিজ্ঞতায়, কামরার অনেকটা জায়গা আটকে তাস খেলা তো চলেই। এমনকী, টাকা ফেলে জুয়া খেলাও হয়। কৃষ্ণেন্দুবাবু বলে চলেন, “সব দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে হয়। প্রতিবাদ করি না। তা হলে হয় তো আমার ট্রেনে যাওয়াটাই বন্ধ হয়ে যাবে।” যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নতুন যাঁরা ট্রেনে চাপেন, তাঁরা মাঝে মধ্যেই প্রতিবাদ করেন। কিন্তু নিত্যযাত্রীরা দলে এতটাই ভারি থাকেন যে প্রতিবাদকারীকে থেমে যেতে হয়। না হলে গোটা পথটা কটূক্তি হজম করতে হয়।
গোবরডাঙার বাসিন্দা সোমনাথ বিশ্বাস নামে এক যুবক জানালেন বনগাঁ লোকালে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর কথায়, “সকালের দিকে মছলন্দপুরের পরে আর বসার জায়গা পাওয়া যায় না। তবে বারাসত এলে দাঁড়িয়ে থাকা নিত্যযাত্রীরা বসার সুযোগ পান। বলা ভাল, তাঁদের পরিচিত সহযাত্রীরা তাঁদের নিজেরাই বসতে দেন। কিন্তু পাশে যদি অচেনা কেউ দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকেন, তিনি সেই সুযোগ পান না। এটা এক রকম অলিখিত নিয়ম।”
হাবরার বাসিন্দা তথা প্রাক্তন কাউন্সিলর শিক্ষক অর্ণব চক্রবর্তী বিড়ার স্কুলে রোজ যাতায়াত করেন। তাঁর অভিজ্ঞতায়, সকাল ৮.৫২-র হাবরা লোকালেও একই ভাবে সিট বুকিং চলে। প্রবীন মানুষ, মহিলারা বুকিং করা সিটের পাশে যে ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন, তা মেনে যায় না।
মহিলা যাত্রীদের অবস্থা হয় আরও খারাপ। ‘সিট বুকিং’ থাকায় বসতে পান না তাঁরা। ভিড় ট্রেনে নানা ভাবে তাঁদের হেনস্থার শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ। বিরাটির একটি স্কুলে হাবরা থেকে শিক্ষকতা করতে যান এক মহিলা। নাম বললেন না। তবে শোনালেন অভিজ্ঞতা। জেনারেল কামরায় উঠতেন আগে। কিন্তু ইদানীং যান মহিলা কামরায়। বললেন, “নিত্যযাত্রীদের জায়গা দখলের লড়াইয়ে পাল্লা দিতে পারতাম না। তা ছাড়া, যাত্রীদের কেউ কেউ দুর্ব্যবহারও করতেন।”
পরিবারের সকলকে নিয়ে কালীঘাটে পুজো দিতে যাওয়ার কথা ছিল মছলন্দপুরের বাসিন্দা অরবিন্দ মজুমদারের। তিনি মাঝে মধ্যে ট্রেনে যাতায়াত করেন। নিত্যযাত্রীদের দুর্ব্যবহার সহ্য করার অভিজ্ঞতা আছে। সাত সকালে ট্রেনে উঠে পরিবারের সদস্যেরা হেনস্থা হবেন, সেটা চাননি। তাই অনেক বেশি টাকা খরচ করে গাড়ি ভাড়া নিয়েই আত্মীয়দের নিয়ে গিয়েছেন কলকাতায়। বস্তুত, ইদানীং স্বচ্ছল পরিবারের অনেকেই সকালে বনগাঁ থেকে কলকাতা বা অন্যত্র যাওয়ার থাকলে ট্রেনে ওঠার বদলে গাড়ি ভাড়া করে নেন। অরবিন্দবাবুর কথায়, “সকালে ট্রেনে জায়গা পাওয়া অসম্ভব। এক শ্রেণির নিত্যযাত্রী ট্রেনে যাতায়াত করাটা দুর্বিষহ করে তুলেছেন। যে ভাবে তাঁরা সিট দখলের ফন্দিফিকির খুঁজে বের করেন, তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের পাল্লা দেওয়া সম্ভব নয়।”
পাল্লা দিতে গিয়েছিলেন বনগাঁর রেলবাজার এলাকার বাসিন্দা অজয় ঘোষ। কিছু আগে তিনি সকালে বনগাঁ লোকালে উঠেছিলেন কলকাতায় যাবেন বলে। সিটে রাখা সিগারেটের প্যাকেট সরিয়ে বসেছিলেন। কিছু ক্ষণ পরে এক যুবক এসে তাঁকে সিট ছাড়তে বলেন। পাল্টা ধমক দেন অজয়বাবু। সিট তিনি ছাড়েননি। কিন্তু জানালেন, ওই দিন নানা ভাবে হেনস্থা করা হয়েছিল তাঁকে। এমনকী, ওই যুবক সামনে বসে সিগারেটও খেয়েছিল। রেল পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন অজয়বাবু। দিন কতক রেল পুলিশের নজরদারি ছিল। কিন্তু অবস্থা ফের যে কে সেই।
সাধারণ কোনও যাত্রী যদি দৈবাত্ সিট পেয়েও যান, তাঁকে বারাসত আসার আগে উঠে পড়ার হুকুম দেন নিত্যযাত্রীরা। কথা অমান্য করলে নানা ভাবে গায়ের উপরে ঝুঁকে পড়ে, পায়ের মধ্যে পা ঢুকিয়ে হেনস্থা করা হয়। জানলা সামনে গিয়ে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে পড়া হয়, যেন হাওয়া ঢোকা বন্ধ হয়ে যায়।
বনগাঁ জিআরপি সূত্রে জানা গিয়েছে, নিত্যযাত্রীদের সিট বুকিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে ওই অভিযান আরও জোরদার করা হবে। কেউ অভিযোগ করলে দ্রুত পদক্ষেপ করা হয়।
আর কী বলছেন নিত্যযীত্রারা?
তাঁদের কেউই নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না। তবে যুক্তি দিলেন অদ্ভুত। বললেন, “দিনের বেশির ভাগ সময় ট্রেনে যাতায়াতেই কেটে যায়। এত ভিড়ের মধ্যে সফরটুকু একটু আরামে না কাটালে চাকরি-বাকরি করবেন কী করে?” তাঁদের বক্তব্য, সিট বুকিং হয় ঠিকই। কিন্তু অসুস্থ মানুষ বা মহিলা-শিশুদের জায়গা ছেড়েও দেন অনেকে। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্য কথাই বলে। অফিস টাইমের বনগাঁ লোকালে নিত্যযাত্রীদের নিয়মিত অভব্যতার সাক্ষী তাঁরা।
(শেষ)