আলো ঝলমলে বারাসতের এক বুটিক।—নিজস্ব চিত্র।
কলকাতার একটি শপিং মল থেকে পুজোর কেনাকাটা সেরে বনগাঁ স্টেশনে নামলেন এক যুবক। পাশের কামরা থেকে একই সঙ্গে নেমে আসা উজ্জ্বল জিনস-টিশার্টের তরুণীর সঙ্গে চোখাচুখি হল। ফ্যাল ফ্যাল করে সে দিকে তাকিয়ে ওই যুবককে বলতে শোনা গেল, “বনগাঁয় আছি না বালিগঞ্জে মাঝে মধ্যে তো বুঝতেই পারি না। পোশাক-আশাকে এখন বনগাঁ দেখছি কলকাতাকেও টক্কর দিচ্ছে।”
টেলিভিশনের দৌলতে এমনিতেই সকলে এখন ‘গ্লোবাল।’ ইন্টারনেটের মাউসের ক্লিকে দুনিয়ার হাল-হকিকত জেনে নিচ্ছে মফসস্ল বা জেলার প্রত্যন্ত প্রান্তের ছেলেমেয়েরাও। বাড়ছে ফ্যাশন সম্পর্কে সচেতনতা। সেই সঙ্গে শহর কলকাতায় অনেকের নিত্য যাতায়াতের সুবাদেও আধুনিক প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ফ্যাশন সম্পর্কে উত্সাহ জোগাচ্ছে। শহরতলির বুটিক হোক কিংবা জেলার জামাকাপড়ের দোকান, ট্রেন্ডি পোশাকের চাহিদা এ বার পুজোয় সর্বত্রই।
এক সময়ে জেলার ফ্যাশন একটু অন্য রকম ছিল তো বটেই, বলছিলেন বনগাঁর এক পোশাক ব্যবসায়ী। কিন্তু এখন এক শ্রেণির মধ্যবিত্তের হাতে টাকার জোগান যেমন বেড়েছে, তেমনই ফ্যাশন সম্পর্কে বেড়েছে সচেতনতা, জানালেন প্রবীন ব্যবসায়ীটি।
বারাসতের বাসিন্দা সোমা দে নামে এক ফ্যাশন ডিজাইনার বলেন, “শুধু কলকাতা থেকে নয়, জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও অনেকে আমার কাছে আসেন পোশাক কিনতে।” সংখ্যাটা আগের থেকে বাড়ছে বলে জানালেন তিনি। বনগাঁর একটি জনপ্রিয় বুটিকের ডিজাইনার সুপর্ণা নাথের কথায়, “শুধু বনগাঁতেই আমার ডিজাইন পোশাকের বাজার সীমাবদ্ধ নয়। বনগাঁ থেকে কয়েক কিলোমিটার ভিতর থেকেও ইদানীং আসছেন ক্রেতারা।” জেলার অন্য প্রান্ত থেকে অনলাইনেও বেশ কিছু অর্ডার পেয়েছেন সুপর্ণা।
এ বার পুজোয় কোন ধরনের পোশাকের চাহিদা বেশি? উত্তর ২৪ পরগনার ব্যবসায়ীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হিচা সিল্ক হোক বা চান্দেরি, ক্রেপ সিল্ক হোক বা সিফন জর্জেট যে কোনও সিল্ককে এ বার পিছনে ফেলে বাংলার তাঁত আবার হিট। ফ্যাশনেবল তাঁতের শাড়ি এবং হ্যান্ডলুমের শাড়ির কদর প্রচুর। তবে তাঁতের শাড়িতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
বারাসতের একটি বুটিকের ডিজাইনার নান্টু সরকার। জানালেন, এ বার সব থেকে বেশি বিক্রি হয়েছে তাঁত ও হ্যান্ডলুমের শাড়ি। তাঁতের শাড়ির উপরে নিজে কিছু কাজ করেছিলেন তিনি। সেগুলি খুব ভাল সাড়া ফেলেছে বলে তাঁর দাবি। তবে এখন যে কোনও পোশাকের ক্ষেত্রেই ছেলেমেয়েরা সুতি বেশি পছন্দ করেন বলে তাঁর অভিজ্ঞতা। জেলার অন্যান্য বুটিক বা দোকানেও তাঁতের শাড়ি বা সুতির কুর্তি-শার্ট বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেল। অল্প বয়সী মেয়েরা ডেনিমের উপরে বেছে নিচ্ছে কটন কুর্তি। এমনকী, চান্দেরি সিল্কের থেকে এখন চান্দেরি কটন বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান বেশ কিছু দোকানদারা। মিক্স অ্যান্ড ম্যাচের পোশাকের চাহিদাও মন্দ নয়। যেমন তাঁতের শাড়ির সঙ্গে মটকার কম্বিনেশন।
শাড়ির সঙ্গে বিক্রি বেড়েছে স্কার্টের। সোমা জানালেন, স্কার্ট পড়ার প্রবণতা এখন প্রবীণদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। একটু ভারি চেহারা হলেও র্যাপার বা স্কার্ট পড়ছেন সকলে। সোমা জানান, তাঁর শাশুড়ির একটু ভারি চেহারা। কিন্তু র্যাপার বা স্কার্টে তাঁকেও বেশ মানিয়ে যাচ্ছে। কয়েক জন ডিজাইনারের অভিজ্ঞতায়, বয়স্কদের মধ্যেও ফ্যাশন সচেতনতা বাড়ছে ইদানীং।
সাজ-পোশাকে ছেলেরাও পিছিয়ে নেই। বুটিকগুলিতে ছেলেদেরও ভিড় চোখে পড়ার মতো। পাঞ্জাবির উপরে ব্লক প্রিন্টের চাহিদা ইদানীং সারা বছরই থাকে। টি-শার্টের উপরে বিভিন্ন পুজোর লোগো, ছড়ার লাইন লেখা থাকছে। হু হু করে বিকোচ্ছে সেই সব।
অষ্টমীর সকালে অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে পাঞ্জাবি পড়ার একটা চল আছেই দীর্ঘ দিন ধরে। কিন্তু এ বার অন্য রকমও ভাবছেন কেউ কেউ। পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে বন্ধুদের সঙ্গে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন শীর্ষেন্দু বিশ্বাস। তাঁর কথায়, “আজকাল গ্রাম বা শহরের মানুষ ফ্যাশন সম্পর্কে সচেতন। সব সময়ে পাঞ্জাবি পড়ে অঞ্জলি দিতে ভাল লাগে না। সাবেক প্রথার সঙ্গে আধুনিকতা মিলিয়ে সাদা রঙের ডিজাইনার টি-শার্ট কিনেছি।” নিজেকে একটু ‘অন্য রকম’ দেখানোর ইচ্ছে নিয়েই পেট্রাপোল থেকে ছুটে এসেছিলেন বারাসতে।
জেলার বুটিকগুলিতেও ইদানীং পোশাকের সঙ্গেই মিলছে নানা রকম জাংক জুয়েলারি। বুটিক মালিকেরা জানালেন, শাড়ির সঙ্গে তো বটেই, কুর্তির সঙ্গেও ভারি গয়নার চাহিদা আছে। ইমপোর্টেট জুয়েলারি বা চাইনিজ হাতের কাজের গয়নাও বিক্রি হচ্ছে। মুক্তো ও নানা রঙের পাথরের গয়না তরুণীদের মধ্যে ভাল সাড়া ফেলেছে।