বই বা গবেষণাপত্র লিখতে গিয়ে শিক্ষক অন্য কারও কাজ থেকে হুবহু নকল করেছেন, এমন অভিযোগ নতুন নয়। কুম্ভিলক বৃত্তির ইতিবৃত্তে রাজ্যের এক শিক্ষক আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার ‘কৃতিত্ব’ অর্জন করে ফেলেছেন বলে খবর! ‘গাইড’ বা নির্দেশকের কাজও করেন ওই শিক্ষক। এবং তাঁরই অধীনে গবেষণা করেছেন, এমন এক ছাত্রের গবেষণাপত্র তিনি নিজের নামে বই হিসেবে প্রকাশ করেছেন বলে অভিযোগ।
অভিযুক্ত শিক্ষকের নাম প্রণাম ধর। তিনি বারাসতের রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান। শুধু নিজের অধীন গবেষকের গবেষণাপত্র নয়, পাকিস্তানের দুই গবেষকের লেখা থেকেও নকল করার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই কয়েক জন শিক্ষক সম্প্রতি এই ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারণ, সংশ্লিষ্ট গবেষক রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই। একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষা দফতরেও অভিযোগ জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছেও অভিযোগপত্র পাঠানো হচ্ছে বলে জানান ওই শিক্ষকেরা। প্রণামবাবু নিজেও অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ উড়িয়ে দিতে পারছেন না।
গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও উচ্চশিক্ষা দফতরের এক কর্তার কাছে যে-চিঠি জমা পড়েছে, তাতে জানানো হয়েছে, ২০১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগ থেকে ‘দ্য চেঞ্জিং প্রোফাইল অব কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কিং ইন ইন্ডিয়া’ নামে একটি গবেষণাপত্রের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয় এক শিক্ষককে (তাঁরই অনুরোধে নাম গোপন রাখা হল)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করে পরে গবেষক তা শেষ করেন প্রণামবাবুর অধীনে। তাঁর সেই গবেষণাপত্রটিকেই প্রণামবাবু নিজের নামে বই হিসেবে প্রকাশ করেছেন বলে অভিযোগ।
ওই গবেষণাপত্র ও প্রণামবাবুর বইয়ের মধ্যে মিল ঠিক কতটা?
গবেষণাপত্র এবং ওই শিক্ষকের বইয়ের বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য, পদ্ধতি, মডেল, অধ্যায়, উপ-অধ্যায় সবই এক। ভূমিকাও হুবহু এক রকম। এমনকী বইটির নাম রাখা হয়েছে গবেষণাপত্রটির নামেই! বইয়ের মুখবন্ধের একট অংশে লেখক তাঁর ‘সুপারভাইজার’-এর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকার করেছেন। প্রশ্ন উঠছে, সুপারভাইজার যদি নিজেই বইটির লেখক হন, তা হলে তিনি অন্য কোনও সুপারভাইজারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবেন কেন?
যাঁর গবেষণাপত্র নকল করার অভিযোগ উঠেছে, তিনি আসানসোল গার্লস কলেজের বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক। বুধবার তিনি বলেন, “গবেষণাপত্রটি আমি বই হিসেবে প্রকাশ করব কি না, গাইড তা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি জানাই, তেমন কোনও ইচ্ছে নেই। পরে কী হয়েছে, বলতে পারব না।”
ওই শিক্ষক-গাইডের নকল-দক্ষতা রাজ্য বা দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পৌঁছে গিয়েছে বলে অভিযোগ! ২০০৭ সালে একটি জার্নালে পাকিস্তানের দুই গবেষকের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। অভিযোগ, সেটির সঙ্গে প্রণামবাবুর একটি গবেষণাপত্রের মিল অনেক। প্রণামবাবুর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ২০১১-য়। দু’টি গবেষণাপত্রই ‘ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল’ বা কার্যকরী মূলধন বিষয়ে। দু’টির সারাংশ, ভূমিকা, গবেষণার পদ্ধতি ও ব্যবহৃত রাশিবিজ্ঞানের সমীকরণ ইত্যাদির পাশাপাশি যে-সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গিয়েছে মিল সবেতেই। শুধু গবেষণার জন্য ব্যবহৃত ‘ডেটা’ বা তথ্যাদির সময়কাল আলাদা।
অভিযুক্ত শিক্ষক বলেন, “গবেষণাপত্রটি আমার নিজস্ব কাজ। নইলে তো জার্নালে ছাপাই যেত না। কারও লেখা থেকে টুকিনি।” তবে বইটি যে পুরোপুরি তাঁর লেখা নয়, তা মেনে নিয়েছেন ওই শিক্ষক। তাঁর কথায়, “বইটির কিছু অংশ ওই গবেষকের গবেষণাপত্র থেকে নেওয়া। বাকিটা আমার লেখা।” তা হলে বইয়ে লেখক হিসেবে তাঁর অধীনে গবেষণা করা ওই শিক্ষকের নাম নেই কেন? প্রণামবাবুর জবাব, “বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকের সঙ্গে আমিও টাকা খরচ করেছি। ওই গবেষক তাঁর পত্রের স্বত্ব দান করেছেন আমাকে।” গবেষক-শিক্ষক অবশ্য দাবি করেছেন, লেখক হিসেবে তিনি নিজের নামটাও বইয়ে রাখতে বলেছিলেন প্রণামবাবুকে। এ ভাবে কারও গবেষণাপত্র নিজের নামে বই হিসেবে ছাপানো যায় না বলেই জানাচ্ছেন প্রবীণ শিক্ষকেরা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় জানান, তাঁরা অভিযোগ পেয়েছেন। “অভিযোগ গুরুতর। সব খতিয়ে দেখে দ্রুত সিদ্ধান্ত হবে,” বলেছেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু। উচ্চশিক্ষা দফতরও একই কথা জানিয়েছে।