ইছামতীর এই চেহারা ভুলতে বসেছেন বনগাঁর মানুষ।
দূর থেকে ভেসে আসত মাঝিদের গলায় ভাটিয়ালির সুর। নদীবক্ষে ভাসমান সাহিত্যপাঠের আসর বসত। পিকনিকে এসে নৌকো নিয়ে নদীতে নেমে কী দাপাদাপিটাই না করতেন দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষ। নদীতে সাঁতার প্রতিযোগিতা দেখতে ভিড় জমত। চাঁদনি রাতে সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে নদীর গায়ে চাঁদের কানাকানি দেখতেন কত মানুষ। জোয়ার-ভাটা খেলত নদীতে। তর্পণের দিনে ঘাটগুলি উপচে পড়ত ভিড়ে। নৌকোয় করে ভাসান দেওয়া হত প্রতিমা। দু’পাড়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন তরুণ-তরুণীরা। কিন্তু বনগাঁয় ইছামতীর সেই কৌলিন্য এখন শুধুই গল্পকথা। কচুরিপানায় মুখ ঢেকে সে হারিয়েছে গতি, সৌন্দর্য এবং উপকারিতাও। বরং নাব্যতা হারিয়ে বন্যায় আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে ইদানীং উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের প্রিয় নদীটি।
ইছামতী উপচে ২০০০ সালে ভয়াবহ বন্যার সাক্ষী ছিল বনগা।ঁ তার আগে থেকেই কমছিল নাব্যতা। যে কারণে সে বার বন্যা ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকায়। রেটপাড়া, আমলাপাড়া, দত্তপাড়া, মাঝেরপাড়ার মতো কয়েকটি এলাকা বাদ দিলে গোটা শহরটাই সে বার চলে গিয়েছিল জলের তলায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিলেন।
২০০৪ সালেও শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়েছিল। পুজোর আগে ভারি বৃষ্টি হলে শহরের বিভিন্ন অংশে এখনও জল দাঁড়িয়ে যায়। নদীর জল ধারণের ক্ষমতা তৈরি না হলে সমস্যা মিটবে না বলেই শহরবাসীর মত। শহরের মধ্যে নদী প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। অথচ ওইটুকু পথ কেন আজও সংস্কার করা গেল না, তা শহরবাসীর কাছে বিস্ময়ের।
মহকুমার ঘাটবাওর, পাইকপাড়া, মণিগ্রাম, দত্তফুলিয়া, কালিয়ানি, ভবানীপুর, মাধবপুর, চাঁদা, গাঁড়াপোতা-সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে খেতের ফসল নৌকায় করে চাষিরা শহরের মতিগঞ্জের হাঁটে সোম-শুক্রবার দিয়ে আসতেন। মৎস্যজীবীরা নদীতে মাছ ধরেই সংসার চালাতেন। প্রতি বছর গোটা পৌষ মাস ধরে শহর-সংলগ্ন সাতভাই কালীতলা এলাকায় ইছামতীর তীরে একটি প্রাচীন কালী মন্দিরকে কেন্দ্র করে বসে পৌষ মেলা। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ওই মেলায় ছুটে আসেন পুজো দিতে। নদীর একপাড়ে মেলা, অন্য পাড়ে বনভোজনের ব্যবস্থা। বনভোজনের টানেও বহু মানুষ এখানে আসেন। কয়েক বছর আগেও বনগাঁ শহর থেকে নৌকোয় করে মানুষ ওই মেলায় যেতেন। নৌকায় মাইক বেঁধে গান বাজিয়ে আনন্দ করতে করতে যুবকেরা মেলায় পাড়ি দিতেন। নৌকায় করে মেলায় যাওয়ার সে ছিল এক আলাদা অভিজ্ঞতা। সেই সব আজ অতীত।
‘পশ্চিমবঙ্গ ইছামতী নদী সংস্কার সহায়তা কমিটি’ সূত্রে জানানো হয়েছে, খাতায়-কলমে নদিয়ার মাজদিয়ার পাবাখালিতে মাথাভাঙা নদী থেকে ইছামতীর সৃষ্টি। বাস্তবে এখন নদীর আর কোনও উৎসমুখই নেই। ওই এলাকায় নদী বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। উৎসমুখ থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নদীটি মোবারকপুরের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৪২ কিলোমিটার। নদী ফের দত্তফুলিয়া এলাকায় এ দেশে ঢুকেছে। ইছামতীর মোট দূরত্ব ২১০ কিলোমিটার। বসিরহাটের হাসনাবাদে গিয়ে ইছামতী দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। একটি কালিন্দী, অন্যটি ধানশা নাম নিয়ে ঘুরপথে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু এখন কচুরিপানায় মুখ ঢাকা, মজে যাওয়া, নাব্যতা হারানো নদীর দিকে তাকিয়ে বনগাঁবাসী ব্যথিত। মৎস্যজীবীরা বিকল্প জীবিকা খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছেন। নদীতে এখন স্নানটুকু পর্যন্ত সারতে পারেন না শহরের মানুষ। শুধু কচুরিপানাই নয়, নদীর বুকে কোথাও কোথাও আগাছা, ঘাস গজিয়ে উঠেছে। একফোঁটা জলের চিহ্ন নেই দেখলে বিশ্বাসই করা কঠিন, এখান দিয়ে নদী বয়ে গিয়েছে।
নদীর রূপ, কার্যকারিতা ফেরাতে কোনও পদক্ষেপই কি হয়নি?
২০০০ সালের বন্যার পরে এলাকার মানুষ ইছামতী সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হন। তদানীন্তন বাম সরকার নদী সংস্কারে উদ্যোগও করে। শহরের মধ্যে রায়ব্রিজের কাছ থেকে নতুনগ্রাম পর্যন্ত নদীর একধারে গার্ডওয়াল দেওয়া হয়। তৈরি হয় রিভারপাম্প। বনগাঁ মহকুমার গাইঘাটার কালাঞ্চি সেতু থেকে স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়া সেতু পর্যন্ত ২০০৫ সালে রাজ্যের পক্ষ থেকে নদী থেকে পলি তুলে নদীর সংস্কার করা হয়েছিল। যদিও ওই সময়ে অভিযোগ ওঠে, নদীর পলি পাড়ে রাখার ফলে ওই পলি বৃষ্টিতে ফের নদীতেই মিশে গিয়েছিল। ওই সংস্কারের বছর চারেক পরে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ভাবে নদী সীমান্ত গাইঘাটার বর্ণবেড়িয়া থেকে কালাঞ্চি পর্যন্ত কেন্দ্রের পক্ষ থেকে নদী থেকে পলি তোলা হয়। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসে কালাঞ্চি থেকে টিপি পর্যন্ত নদীর পলি তুলে নদী সংস্কার করেছে। কিন্তু নদী তার পুরনো অবস্থায় ফেরেনি।
২০১০ সালে বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ উদ্যোগী হয়ে কচুরিপানা তোলানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কাজটা হয়েছিল একশো দিনের প্রকল্পে। নদী সাময়িক মুক্ত হলেও ফের কচুরিপানায় ভরে গিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ওই প্রকল্পে আর কচুরিপানা তোলা যাবে না। ফলে কচুরিপানা আর তোলা যায়নি। তবে সম্প্রতি পুরসভার পক্ষ থেকে নিজস্ব তহবিল থেকে টাকা খরচ করে কচুরিপানা তোলা হচ্ছে। কিন্তু পুরসভার একার পক্ষে যে নদী সম্পূর্ণ কচুরিপানা মুক্ত করে নাব্যতা ফেরানো সম্ভব নয়, তা এলাকার মানুষও জানেন।
‘পশ্চিমবঙ্গ ইছামতী নদী সংস্কার সহায়তা কমিটি’র সভাপতি সুভাষ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “৬ জানুয়ারি সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে একটি বৈঠক ডেকেছেন জলসম্পদ ভবনে। কী ভাবে ইছামতীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করা যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করা নিয়ে আলোচনা হবে।
সম্প্রতি বনগাঁ শহরে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে গিয়েছেন, ইছামতী সংস্কারের জন্য ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তৃণমূলের বিশ্বজিৎ দাস নদীর ভয়াবহ অবস্থার প্রসঙ্গে বলেন “আমি বিধানসভায় ইছামতী থেকে কচুরিপানা তোলা ও নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের বিষয়টি তুলেছি। বিষয়টি শুধু বনগাঁ শহরের সমস্যা নয়। গোটা ইছামতীরই সমস্যা। মুখ্যমন্ত্রী অর্থ বরাদ্দ করেছেন। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।”
(চলবে)