প্রতি দিনই এমন হাঁসফাঁস দশা হয় শহরের। —নিজস্ব চিত্র।
প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো জয়নগর-মজিলপুর পুরসভা। অনেক মনীষী, কবি-সাহিত্যিক, বিপ্লবীর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এলাকার আনাচে কানাচে। অথচ আধুনিক শহরের মতো আজও সেজে উঠতে পারল না জয়নগর-মজিলপুর। নানা অনুন্নয়নের পাশাপাশি পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে তিতিবিরক্ত বাসিন্দারা।
১৮৬৯ সালে পুরসভার শুরুতে ৩টি ওয়ার্ড নিয়ে পুরবোর্ড গঠন হয়। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন এই পুরসভার ১৪টি ওয়ার্ড। বসবাস প্রায় ৩০ হাজার মানুষের। জয়নগর থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য এখানে একমাত্র ভরসা হল ট্রেন। ফলে নিত্য প্রয়োজনে অফিসে কলকাতায় যাতায়াত করতে হয় ট্রেনে করেই। ১৯২৯ সালে প্রথম জয়নগর-মজিলপুর স্টেশনে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। কিন্তু এখন সারা দিনে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা অন্তর ট্রেন চলে। যা যাত্রীর তুলনায় যথেষ্ট কম। দিনে দিনে জনসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় ট্রেন বাড়েনি। জয়নগর-মজিলপুর স্টেশন থেকে শিয়ালদহ প্রায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা মানুষকে গাদাগাদি করে ভিড়ের মধ্যেই যেতে হয়। বিশেষত সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ট্রেনে এতই ভিড় হয় যে অনেকে ট্রেনে উঠতেই পারেন না। ফলে অতিরিক্ত ভাড়া খরচ করে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্ল্যাটফর্মে ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। মুমূর্ষ রোগীকে ট্রেনে করে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে রোগীর আত্মীয়-পরিজনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। স্থানীয় মহিলা নিত্যযাত্রী ও কলেজ ছাত্রীদের অভিযোগ, মহিলা কামরায় অনেকের ব্যবহার খুবই খারাপ। অনেকে ট্রেনের মধ্যে ধূমপান করেন বলেও অভিযোগ। সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে এ সব সমস্যা এড়ানো যেত বলে জানান বহু নিত্যযাত্রী।
এই শহর থেকে সড়কপথে কলকাতায় যাওয়ার জন্য মাস কয়েক আগে এসইউসি-র স্থানীয় বিধায়ক তরুণ নস্কর দিনে একটি সরকারি বাস চলাচলের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং পরিষেবা একদমই ভাল নয় বলে অভিযোগ। সড়কপথে বারুইপুর শহরে আসতে হলে ট্রেকার বা অটোর উপর নির্ভর করতে হয়। যাত্রীদের অভিযোগ, জয়নগর স্টেশন মোড়, মিত্র বাজার, সূর্যপুর ঘাট ও দক্ষিণ বারাসত বাজার মোড়গুলিতে নিত্য যানজটে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে গন্তব্যে পৌঁছতেও দেরি হয়। এই রাস্তাগুলিতে আজ পর্যন্ত গাড়ি রাখার কোনও স্ট্যান্ড তৈরি হয়নি। ফলে যত্রতত্র গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। এতে যানজট তৈরি হয়।
তরুণবাবু বলেন, ‘‘সড়কপথে কলকাতা যাতায়াতের জন্য যে বাসটি চালু করা হয়েছে, তা বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যানজট এড়াতে বাইপাস রাস্তা করার জন্য ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর বিধানসভায় পূর্তমন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। এমনকী, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে সেখান থেকেও না বলে দেওয়া হয়েছে। আর অনেক আন্দোলনের পরে কয়েক মাস আগে লক্ষ্মীকান্তপুর পর্যন্ত ডবল লাইন চালু করতে পেরেছি। ট্রেন বাড়ানোর জন্য রেলমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানিয়েছি।’’
শহরের আরও একটি প্রধান সমস্যা হল নিকাশি নিয়ে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে যাতায়াতের রাস্তাঘাটের অবস্থাও খারাপ। এক সময় যে প্রায় ১ কিলোমিটার চওড়া আদি গঙ্গা জয়নগরের বুক চিরে সাগরের মুড়িগঙ্গা নদীতে মিশেছিল। ওই গঙ্গা ভরাট করে তৈরি হয়েছে বড় বড় ঘরবাড়ি, দোকান। ফলে মজে যাওয়া গঙ্গা এখন কোথাও কোথাও স্রোতহীন ডোবা বা পুকুরে পরিণত হয়েছে। নিকাশি ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে এই শহরে। বর্ষায় অল্প বৃষ্টিতেও রাস্তার উপর জল থইথই করে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নিকাশি নালাগুলি কবে শেষ সংস্কার হয়েছে তা প্রবীণেরাও মনে করে বলতে পারলেন না। ফলে মশার উপদ্রবে অস্থির এলাকাবাসী। দিনের বেলাতেও মশারি খাটিয়ে থাকতে হয় বাসিন্দাদের। আজ পর্যন্ত বাড়িতে বাড়িতে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল সরবরাহ করতে পারল না পুরসভা। বেশ কিছু ওয়ার্ডে পানীয় জলের নলকূপের সংখ্যাও যথেষ্ট কম। ফলে দূর থেকে জল সংগ্রহ করতে হয়।
দীর্ঘ দিন ধরে এই পুরসভায় ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। দলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রশান্ত সরখেল বলেন, ‘‘আমার সময়ে নিকাশি সমস্যার সমাধান, রাস্তাঘাট সংস্কারের উদ্যোগ করা হয়েছিল। তবে সব কাজ শেষ করা যানি এ কথা ঠিক।’’ গত পাঁচ বছর পুরসভায় ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল। দলের বিদায়ী চেয়ারম্যান ফরিদা বেগম শেখ বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন মাটির রাস্তা কংক্রিটের করেছি। পানীয় জল সরবরাহের জন্য ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। তবে দীর্ঘ দিন কংগ্রেস হাতে থাকার পরেও এই পুরসভায় উন্নয়ন বহু কাজ বাকি থেকে গিয়েছে। যা আমরা মাত্র পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে সবটা করে উঠতে পারিনি। এ বার পুরবোর্ড গড়ার দৌড়ে এগিয়ে কংগ্রেস। বাসিন্দারাও উন্নয়নের কাজ কিছু হয় কিনা, বহু আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন সে দিকেই।
(চলবে)