প্রতীকী ছবি।
দুপুরে ভাত-ডাল খেয়ে ব্যবসার কাজে বেরোচ্ছিলেন স্বামী। মোবাইল ফোন, টাকার ব্যাগ এগিয়ে দিলেন স্ত্রী। আর দিলেন রুমালে মোড়া বস্তুটা। গজগজ করতে করতে বললেন, ‘‘আসল জিনিসটাই নিয়ে যেতে ভুলে যাও বার বার।’’
একগাল হেসে ঠান্ডা লোহার জিনিসটা কোমরে গুঁজে বেরিয়ে পড়লেন স্বামী।
‘আসল’ জিনিসটা হল ওয়ানশটার। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক কর্তার মুখে শোনা গল্পটা। যিনি গল্পটা বলা শেষ করলেন এই বলে, ‘‘বাসন্তীর চড়াবিদ্যা পঞ্চায়েতের গ্রামের ঘরে ঘরে এখন এই অবস্থা। বারুদের স্তূপের উপরে বসে আছে গোটা এলাকাটা।’’
গত কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ সে দিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ক’দিন আগেই তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর লড়াইয়ে হেতালখালিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে ন’বছরের এক বালক-সহ ২ জন। গুলিবিদ্ধ হন এক পুলিশ কর্মী-সহ আরও কয়েক জন। গত ছ’মাসে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন খুন হয়েছেন। ছোটখাট মারপিট, হাঙ্গামা, বোমা-গুলির ল়ড়াই তো লেগেই আছে। সব খবর পুলিশের কান পর্যন্ত পৌঁছয়ও না।
বাসন্তীর গ্রামে শাসকদলের গোষ্ঠীকোন্দলের দিকে দলের শীর্ষস্তরের নজর আছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী গোলমাল থামাতে নির্দেশ দিয়েছেন। দলের স্থানীয় কমিটিগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গোসাবার সভা থেকে ‘মিলেমিশে’ কাজ করার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু হলে কী হবে, বাসন্তী আছে নিজের রঙেই। বাম আমল থেকেই রাজনৈতিক খুনোখুনির জন্য ‘নাম কুড়িয়েছে’ বাসন্তী। বহু রক্তপাতের সাক্ষী এই সব এলাকা। রাজ্য পুলিশের এক গোয়েন্দা বলেন, ‘‘এত অস্ত্র ইতিমধ্যেই ঘুরছে লোকের হাতে হাতে, আমরাও কূল করতে পারছি না।’’ হেতালখালির ঘটনায় প্রায় সাড়ে চারশো রাউন্ড গুলি চলেছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার দিন কয়েকের মধ্যে ক্যানিং স্টেশন এলাকা থেকে চারজনকে গ্রেফতার করে উদ্ধার হয়েছে সাড়ে তিনশো রাউন্ড গুলি। বিহারের সিওয়ান থেকে এনে সে সব বাসন্তীর গ্রামেই পাচার হচ্ছিল বলে জানতে পারেন গোয়েন্দারা।
আরও জানা যায়, স্থানীয় লোকের মুখে ইদানীং গুলির নাম হয়েছে ‘খাবার’। আর আগ্নেয়াস্ত্রের নাম, ‘মুরগি।’ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘মুরগির এখন আর অভাবে নেই এলাকায়। তবে ইদানীং খাবারে টান পড়েছে।’’
নাইন এমএম, সেভেন এমএম, ওয়ান শটার, পাইপ গান— মুঙ্গের-সহ অন্যান্য এলাকা থেকে নানা ধরনের অস্ত্রের ভান্ডার মজুত হয়েছে বাসন্তীর চড়াবিদ্যা পঞ্চায়েতের হেতালখালি, কুমড়োখালি, ফুলমালঞ্চ, আমঝাড়ার মতো গ্রামগুলিতে। উন্নতমানের একটি গুলির দাম প্রায় সাড়ে ৪০০ টাকা। কিন্তু সে সবের পিছনে টাকা জোগানোর লোকের অভাব নেই। সম্প্রতি ক্যানিং স্টেশন এলাকা থেকে যে গুলি উদ্ধার হয়েছে, তা কেনার জন্য বিহারের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা জমা পড়েছিল বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।
কিন্তু কেন এত অস্ত্রের চাহিদা বাসন্তীতে? কী সেই ‘মধু’, যার খোঁজে প্রাণঘাতী লড়াইয়ে নেমেছে শাসক দলের দু’পক্ষ? (চলবে)