বিশ্বকর্মা পুজোর থিমেও ধরা পড়ল পরিবহণ শিল্পে সমস্যার কথা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বনগাঁর ট্রাক পরিবহণ ব্যবসা। স্থানীয় সূত্রের খবর, ক্ষতি সামাল দিতে না পেরে দলে দলে মালিক ট্রাক বিক্রি করে দিচ্ছেন। রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের। অনেকেই বেছে নিচ্ছেন অন্য পেশা। কেউ রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছেন, কেউ টোটো চালাচ্ছেন। কাজের খোঁজে কেউ কেউ পাড়ি দিচ্ছেন ভিন্ রাজ্যেও।
বনগাঁর অর্থনীতি অনেকটাই দাঁড়িয়ে ট্রান্সপোর্ট বা ট্রাক পরিবহণ ব্যবসার উপরে। ট্রাক মালিক ও শ্রমিকেরা জানান, কয়েক বছর ধরেই ব্যবসার অবস্থা খারাপ। নোটবন্দি, জিএসটি, আর্থিক মন্দার প্রভাবে ব্যবসা খারাপ চলছিল। পরবর্তীকালে লকডাউনে ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। করোনার পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে পণ্যভর্তি ট্রাক চলাচলে স্বচ্ছতা আনতে রাজ্য সরকার ‘সুবিধা’ নামে একটি পোর্টাল চালু করেছে। মালিক-শ্রমিকদের দাবি, এই
পোর্টাল চালু হওয়ার পর থেকেই বনগাঁর ট্রাক পরিবহণ ব্যবসা আরও খারাপ হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, বনগাঁ মহকুমায় ছ’হাজারের বেশি ট্রাক ছিল। ট্রাক প্রতি গড়ে তিন জন করে শ্রমিক কাজ করতেন। বর্তমানে আর্থিক ক্ষতির জেরে ট্রাকের সংখ্যা কমে হাজার দু’য়েকে ঠেকেছে। বনগাঁর ট্রাক মালিকদের সংগঠন, সীমান্ত পরিবহণ মালিক সমিতির সম্পাদক অশোক দেবনাথ বলেন, “বনগাঁয় ছ’হাজারের বেশি ট্রাক ছিল। বনগাঁর প্রধান ব্যবসা ট্রাক পরিবহণ। এখন কাজ না থাকায় মালিকেরা ট্রাক বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্তমানে দু’হাজার ট্রাক রয়েছে। আমাদের সংগঠনের ২১ জন কমিটি সদস্যের ১২ জনই ট্রাক বিক্রি করে অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। পরিস্থিতি না পাল্টালে ব্যবসাটাই উঠে যাবে।”
ট্রাক মালিক ও শ্রমিকেরা জানাচ্ছেন, সুবিধা পোর্টাল চালু হওয়ার আগে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্যভর্তি ট্রাক প্রথমে বনগাঁ শহরে আসত। পুরসভার ট্রাক পার্কিং বা বেসরকারি পার্কিংয়ে সেই মালপত্র নামিয়ে স্থানীয় ট্রাকে তোলা হত। তারপর নির্দিষ্ট দিনে সেই ট্রাক পণ্য রফতানির জন্য পেট্রাপোল বন্দরে চলে যেত। বাইরে থেকে আসা ট্রাক রাখার জন্য বেসরকারি অনেক পার্কিং এবং মালপত্র রাখার জন্য গুদাম তৈরি হয়েছিল বনগাঁয়। কিন্তু সুবিধা পোর্টাল চালু হওয়ার পরে এখন বাইরের রাজ্য থেকে আসা ট্রাকগুলিকে বনগাঁ শহরে অপেক্ষা করতে হয় না। সেই ট্রাক সরাসরি পেট্রাপোল বন্দরে চলে যায়। ফলে স্থানীয় ট্রাকে মালপত্র ওঠানো-নামানোর প্রয়োজন হচ্ছে না। স্থানীয় ট্রাক মালিক-শ্রমিকদের কাজকর্ম কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, “সুবিধা পোর্টাল চালু হওয়ায় ট্রাক চলাচল স্বচ্ছ হয়েছে। রফতানিকারীরা উপকৃত হয়েছেন। তবে বনগাঁর আঞ্চলিক অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ট্রাক মালিক-সহ প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক আর্থিক সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছেন। স্থানীয় ট্রাক মালিকদের কাজ দেওয়ার জন্য সরকারি কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কী ভাবে সমস্যা মেটানো যায়, তা দেখার আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা।”
ট্রাক মালিক ও শ্রমিকদের দুর্দশার কথা উঠে এসেছে এলাকার বিশ্বকর্মা পুজোর থিমেও। বনগাঁর নিউমার্কেট এলাকায় সিটু অনুমোদিত বনগাঁ জনপথ পরিবহণ মজদুর ইউনিয়নের বিশ্বকর্মা পুজোর মণ্ডপে ট্রাক বিক্রি, সারি সারি ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকার ছবি উঠে এসেছে। সিটু নেতা ধৃতিমান পাল বলেন, “রাজ্য সুবিধা পোর্টাল চালু করেছে। এর ফলে স্থানীয় ট্রাক পরিবহণ ব্যবস্থা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কাজ না থাকায় ট্রাক মালিক ও শ্রমিকদের রুজি রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মালিকেরা ট্রাক বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। শ্রমিকেরা বিকল্প পেশা বেছে নিচ্ছেন। বনগাঁর অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। সেই বাস্তবটা পুজোয় থিমের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।”