প্রতীকী ছবি।
পড়তে ভাল লাগে না, তাই ক’দিন আগেই বাড়ি থেকে পালিয়েছিল এক ছাত্র। পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
মঙ্গলবার একই ঘটনা ঘটল হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের বিশপুর পঞ্চায়েত এলাকার একটি স্কুলে। পয়লা মে অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্র প্রতিবেশী কয়েকজন যুবকের সঙ্গে তামিলনাড়ুর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ইচ্ছে ছিল শ্রমিকের কাজ করে রোজগার করবে। মঙ্গলবার তামিলনাড়ু পুলিশ ওই ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে, বয়স আঠারোর কম। বাড়িতে খবর দেয় সেখানকার পুলিশ। ছেলেটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলেছে তারা।
ওই কিশোরের বাবা দিনমজুরির কাজ করেন। তিনি জানান, ছেলের পড়াশোনায় মন বসত না। স্কুল খোলার পরেও নিয়মিত যেত না। তাঁর কথায়, ‘‘খুব সমস্যায় পড়লাম। একা যেতে পারব না ছেলেকে আনতে। সঙ্গে কাউকে নিতে হবে। এ দিকে, বাড়িতে টাকা নেই। যাতায়াত খরচের জন্য চড়া সুদে কয়েক হাজার টাকা ঋণ করতে হবে।’’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, শুধু এই ছাত্র নয়, স্কুল খোলার পর থেকে এখনও পর্যন্ত দশম শ্রেণির ১০ জন, অষ্টম-নবম শ্রেণি মিলিয়ে আরও ১০ জন ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে বার বার গিয়ে বাবা-মাকে বুঝিয়েও তাদের স্কুলে ফেরানো যায়নি। সকলেই শ্রমিকের কাজে যুক্ত।
এই স্কুলের দশম শ্রেণির দুই ছাত্রী ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করে। দশম শ্রেণির এক ছাত্র স্কুলের পাশের এক গ্যারাজে কাজ করে। কেউ রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ খুঁজে নিয়েছে। দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে তার বাবা ২৫ হাজার টাকার ফোন কিনে না দেওয়ায় সে পড়া ছেড়ে বাবার মুদির দোকানে কাজ শুরু করেছে বলেও জানা গেল।
প্রধান শিক্ষকের কথায়, ‘‘বার বার বাড়ি গিয়ে অভিভাবক ও পড়ুয়াদের বুঝিয়েও কোনও কাজ হয়নি। বাড়ি গেলে অভিভাবকেরা বলেন, স্কুলে পাঠাবেন। তারপরে আর পাঠান না। কিছু অভিভাবক ও পড়ুয়া বলে, পড়াশোনা করে কী হবে। তার থেকে রোজগার করলে ভাল। শিশুশ্রমে যুক্ত পড়ুয়াদের স্কুলে ফেরাতে পঞ্চায়েত সদস্য, চাইল্ড লাইন— সকলকে জানিয়েছি।’’
সন্দেশখালি ২ ব্লকের আতাপুর কেনারাম হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির ২২ জন ছাত্র কেরলে শ্রমিকের কাজে গিয়েছে বলে জানা গেল। সন্দেশখালি রাধারানি হাইস্কুল সূত্রের খবর, দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠে ৩০ জন ছাত্র ফোন কেনার টাকা হাতে পেতেই শ্রমিকের কাজে চলে গিয়েছে।
বিভিন্ন স্কুলেই এই চিত্র। হিঙ্গলগঞ্জের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক পুলক রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতির কারণ, অভিভাবকদের অসচেতনতা এবং পড়ুয়াদের মধ্যে টাকা আয় করে দামি মোবাইল, বাইক, পোশাক কেনার আকর্ষণ। শুধু স্কুলের পক্ষে এই প্রবণতা রোধ করা সম্ভব নয়। অভিভাবক ও স্থানীয় মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।’’
আইআইএম বেঙ্গালুরুর অর্থনীতির অধ্যাপক অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকাটা পড়াশোনা থেকে বিমুখ হওয়ার একটা কারণ। সেই সঙ্গে যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে পড়ুয়ারা রয়েছে, সেটাও একটা বড় কারণ।’’ তাঁর মতে, ভোকেশনাল কোর্স করে যদি কাজে যুক্ত হয় পড়ুয়ারা, তবুও কিছুটা ভাল হবে তাদের ভবিষ্যতের জন্য। এটা অন্তত বোঝাতে হবে।
বারাসত স্টেট ইউনিভার্সিটির মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান সঞ্চিতা ঘোষ বলেন, ‘‘করোনা কালে পড়ুয়াদের নিজেদের মধ্যে অফলাইন যোগাযোগ কমে যায়। ক্লাসে সকলে মিলে পড়াশোনার মাধ্যমে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার যে মোটিভেশন, তাতেও ঘাটতি পড়ে। অতিমারি মানুষের রুজিরোজগারেও মারাত্মক আঘাত করেছে। তাই আর্থিক প্রয়োজনীয়তা ও শখ-শৌখিনতা চটজলদি মেটাতে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ বেছে নেওয়ার ভাবনা বাসা বাঁধছে শিশুমনে।’’
ছোটদের এই প্রবণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন বারাসত স্টেট ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘‘এর প্রভাব খুবই খারাপ। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রস্তুত হচ্ছে না। অদক্ষ শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে।’’