শ্রদ্ধার আসন টলমল
TET Scam

মেয়ে দেখতে গিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে শিক্ষকদের

নিয়োগ-দুর্নীতির ফলে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষক সমাজের প্রায় সকলেই এখন অবিশ্বাসের মুখে। ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন নাকি, সর্বত্রই ঠারেঠোরে এই কটাক্ষ ধেয়ে আসছে।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র  

বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:১৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

বনগাঁ শহরের শিমুলতলার বাসিন্দা অভিষেক দে-র বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পাত্রী দেখা হচ্ছিল। কিছুদিন আগে একটি বাড়িতে মেয়েকে দেখতেই গিয়েছিলেন অভিষেক। সেখানে গিয়ে বিড়ম্বনার মুখেপড়তে হয় প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক যুবকটিকে।

Advertisement

কথাবার্তা ভালই জমে উঠেছিল। ইতিমধ্যে পাত্রীর এক অভিভাবক মুখের উপরে প্রশ্ন করে বসেন, আপনি কোন বছরে চাকরি পেয়েছেন। অভিষেক জানান, ২০২১ সালেই কাজে যোগ দিয়েছেন। মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করেন পাত্রীর বাড়ির লোকজন। অভিষেক বলেন, ‘‘আমি পাত্রীর অভিভাবকদের বুঝিয়ে বলি, ২০০৯ সালে টেট পরীক্ষা পাশ করি। রাজ্য সরকার নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে আমরা আদালতে মামলা করি। আদালতের নির্দেশে গত বছর বছর নিয়োগপত্র পাই। স্কুলে যোগদানও করি। কাউকে কোনও টাকা দিয়ে চাকরি পাইনি।’’

অভিষেকের মুখে সব কথা শুনে অবশ্য আশ্বস্ত হয়েছেন মেয়ের বাড়ির লোকজন। সামনেই বিয়ে। তবে মেঘ পুরো কেটেছে তা নয়। অভিষেক জানালেন, হবু স্ত্রী এবং তাঁর আত্মীয়দের প্রায়শই প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে, ছেলের চাকরিটা মাঝপথে চলে যাবে না তো’

Advertisement

অভিষেক হতাশ। তাঁর কথায়, ‘‘পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে, মামলা করে নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেলাম। কাউকে এক টাকাও দিতে হল না। অথচ, লোকজনের চোখে একটা অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।’’

২০০৯ সালে টেট পাশ করা আর এক যুবকও গত বছর সেপ্টেম্বরমাসে নিয়োগপত্র পেয়ে শিক্ষকতা করছেন। সেই যুবক বাড়ি তৈরি করবেন বলে একটি বেসরকারিব্যাঙ্কে ঋণের আবেদন করেন। অভিযোগ, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এক বছরের পে স্লিপ দেখে তারপরে ঋণমঞ্জুর করার কথা ভাবা হবে। ওই যুবকের কথায়, ‘‘সাধারণত তিন মাসের পে স্লিপ দেখে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ দেওয়া হয়। আমাকে দেওয়া হল না। চাকরি চলে যেতে পারে, এই সন্দেহই হয় তো করছেনব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ।’’

এসএসসি এবং টেটে নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে রাজ্যে তোলপাড় চলছে। এ সবের ফল ভোগ করতে হচ্ছে বহু তরুণ শিক্ষককে। তৈরি হয়েছেঅশ্রদ্ধা, অবিশ্বাসের বাতাবরণ। পথেঘাটে, ট্রেনে-বাসে, চায়ের দোকানের আড্ডায় কটূক্তি ভেসে আসছে শিক্ষকদের দিকে।

প্রাথমিক স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ‘‘চায়ের দোকানে সন্ধ্যার পরে নিয়মিত আড্ডা দিতে যেতাম। নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে এত কথা শুনতে হয় গেলেই, আড্ডা বন্ধ করে দিয়েছি। কিছু লোকের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজকে কলুষিত মনে করা হচ্ছে।’’

এক শিক্ষক জানালেন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। ট্রেনে করে স্কুলে যাতায়াত করেন তিনি। আগে ভিড় ট্রেনে অনেকে ‘স্যারকে’ সিট ছেড়ে দিতেন। এখন নাকি আর দিচ্ছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষের চোখে আমাদের সম্মানটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’’

বনগাঁ হাইস্কুলের শিক্ষক চন্দন ঘোষ শোনালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। ট্রেনে পরিচিত সহযাত্রীরা একদিন আলোচনা করছিলেন, নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে। তিনি আসতেই ভিড়টা চুপ করে গেল। সরাসরি কেউ কিছু না বললেও অস্বস্তিতে পড়ে যান চন্দন নিজেই।

দেবায়ন মণ্ডল ২০১৯ সালে চাকরি পেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অভিভাবকদের মধ্যে আলোচনা শুনতে পাই, আমি কবে চাকরি পেয়েছি— সে সব প্রসঙ্গ নিয়ে কথাও ভেসে এসেছে কানে। সামনে হয় তো কেউ কিছু বলছেন না। কিন্তু আসলে সন্দেহের চোখে দেখছেন। আমজনতার কাছে তরুণ শিক্ষকেরা যেন সকলেই টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন!’’

বনগাঁ মহকুমায় সমস্যাটা আরও তীব্র। বাগদার বাসিন্দা চন্দন মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বহু ছেলেমেয়েকে টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের প্রতি মানুষের প্রশ্ন, ‘‘এটা চন্দন-কেস না তো?’’

মেয়ে দেখতে গিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে শিক্ষকদের

শ্রদ্ধার আসন টলমল

নিয়োগ-দুর্নীতির ফলে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষক সমাজের প্রায় সকলেই এখন অবিশ্বাসের মুখে। ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন নাকি, সর্বত্রই ঠারেঠোরে এই কটাক্ষ ধেয়ে আসছে। আনন্দবাজারের প্রতিবেদন

সীমান্ত মৈত্রবনগাঁ

বনগাঁ শহরের শিমুলতলার বাসিন্দা অভিষেক দে-র বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পাত্রী দেখা হচ্ছিল। কিছুদিন আগে একটি বাড়িতে মেয়েকে দেখতেই গিয়েছিলেন অভিষেক। সেখানে গিয়ে বিড়ম্বনার মুখেপড়তে হয় প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক যুবকটিকে।

কথাবার্তা ভালই জমে উঠেছিল। ইতিমধ্যে পাত্রীর এক অভিভাবক মুখের উপরে প্রশ্ন করে বসেন, আপনি কোন বছরে চাকরি পেয়েছেন। অভিষেক জানান, ২০২১ সালেই কাজে যোগ দিয়েছেন। মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করেন পাত্রীর বাড়ির লোকজন। অভিষেক বলেন, ‘‘আমি পাত্রীর অভিভাবকদের বুঝিয়ে বলি, ২০০৯ সালে টেট পরীক্ষা পাশ করি। রাজ্য সরকার নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে আমরা আদালতে মামলা করি। আদালতের নির্দেশে গত বছর বছর নিয়োগপত্র পাই। স্কুলে যোগদানও করি। কাউকে কোনও টাকা দিয়ে চাকরি পাইনি।’’

অভিষেকের মুখে সব কথা শুনে অবশ্য আশ্বস্ত হয়েছেন মেয়ের বাড়ির লোকজন। সামনেই বিয়ে। তবে মেঘ পুরো কেটেছে তা নয়। অভিষেক জানালেন, হবু স্ত্রী এবং তাঁর আত্মীয়দের প্রায়শই প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে, ছেলের চাকরিটা মাঝপথে চলে যাবে না তো’

অভিষেক হতাশ। তাঁর কথায়, ‘‘পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে, মামলা করে নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেলাম। কাউকে এক টাকাও দিতে হল না। অথচ, লোকজনের চোখে একটা অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।’’

২০০৯ সালে টেট পাশ করা আর এক যুবকও গত বছর সেপ্টেম্বরমাসে নিয়োগপত্র পেয়ে শিক্ষকতা করছেন। সেই যুবক বাড়ি তৈরি করবেন বলে একটি বেসরকারিব্যাঙ্কে ঋণের আবেদন করেন। অভিযোগ, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এক বছরের পে স্লিপ দেখে তারপরে ঋণমঞ্জুর করার কথা ভাবা হবে। ওই যুবকের কথায়, ‘‘সাধারণত তিন মাসের পে স্লিপ দেখে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ দেওয়া হয়। আমাকে দেওয়া হল না। চাকরি চলে যেতে পারে, এই সন্দেহই হয় তো করছেনব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ।’’

এসএসসি এবং টেটে নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে রাজ্যে তোলপাড় চলছে। এ সবের ফল ভোগ করতে হচ্ছে বহু তরুণ শিক্ষককে। তৈরি হয়েছেঅশ্রদ্ধা, অবিশ্বাসের বাতাবরণ। পথেঘাটে, ট্রেনে-বাসে, চায়ের দোকানের আড্ডায় কটূক্তি ভেসে আসছে শিক্ষকদের দিকে।

প্রাথমিক স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ‘‘চায়ের দোকানে সন্ধ্যার পরে নিয়মিত আড্ডা দিতে যেতাম। নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে এত কথা শুনতে হয় গেলেই, আড্ডা বন্ধ করে দিয়েছি। কিছু লোকের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজকে কলুষিত মনে করা হচ্ছে।’’

এক শিক্ষক জানালেন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। ট্রেনে করে স্কুলে যাতায়াত করেন তিনি। আগে ভিড় ট্রেনে অনেকে ‘স্যারকে’ সিট ছেড়ে দিতেন। এখন নাকি আর দিচ্ছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষের চোখে আমাদের সম্মানটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’’

বনগাঁ হাইস্কুলের শিক্ষক চন্দন ঘোষ শোনালেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। ট্রেনে পরিচিত সহযাত্রীরা একদিন আলোচনা করছিলেন, নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে। তিনি আসতেই ভিড়টা চুপ করে গেল। সরাসরি কেউ কিছু না বললেও অস্বস্তিতে পড়ে যান চন্দন নিজেই।

দেবায়ন মণ্ডল ২০১৯ সালে চাকরি পেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অভিভাবকদের মধ্যে আলোচনা শুনতে পাই, আমি কবে চাকরি পেয়েছি— সে সব প্রসঙ্গ নিয়ে কথাও ভেসে এসেছে কানে। সামনে হয় তো কেউ কিছু বলছেন না। কিন্তু আসলে সন্দেহের চোখে দেখছেন। আমজনতার কাছে তরুণ শিক্ষকেরা যেন সকলেই টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন!’’

বনগাঁ মহকুমায় সমস্যাটা আরও তীব্র। বাগদার বাসিন্দা চন্দন মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বহু ছেলেমেয়েকে টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের প্রতি মানুষের প্রশ্ন, ‘‘এটা চন্দন-কেস না তো?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement