অরক্ষিত: রক্ষী নেই বনগাঁ-রানাঘাট লোকালের মহিলা কামরায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
প্রায় ফাঁকা মহিলা কামরায় তরুণীকে উত্ত্যক্ত করে চলন্ত ট্রেন থেকে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বনগাঁ-রানাঘাট লোকালে। ঘটনা জানাজানি হতেই ওই লোকালে যাতায়াত করা মহিলারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে, রাতের ট্রেনে যাতায়াত করেন যাঁরা, তাঁরা অনেকে জানাচ্ছেন, রাতের দিকে মহিলা কামরায় সব সময়ে পুলিশ থাকে না। রাতের মহিলা কামরায় সর্বক্ষণের জন্য পুলিশ মোতায়নের দাবি তুলেছেন অনেকেই। মহিলা কামরায় যখন-তখন পুরুষ যাত্রীরা উঠে পড়েন বলে অভিযোগ। ফলে রাতবিরেতে মহিলা কামরার যাত্রীরা অস্বস্তি বোধ করেন।
কোনও কোনও সময়ে পুরুষ যাত্রীদের কেউ কেউ মহিলাদের উত্ত্যক্ত করে বলেও অভিযোগ। ব্যাগ ছিনতাই করে পালায়। মহিলা কামরায় পুরুষদের ওঠা বন্ধ করার দাবিও তুলছেন অনেকে।
সাধনা শীল নামে এক মহিলা রাতে বনগাঁ-রানাঘাট লোকালে চেপে বাড়ি ফেরেন বনগাঁ থেকে। রবিবার মহিলা কামরায় বসে সাধনা বলেন, ‘‘মহিলা কামরায় প্রায়ই পুরুষেরা উঠে পড়েন। পুলিশ মাঝে মধ্যে থাকলেও সব সময়ে থাকে না। থাকলে ওই তরুণীর আজ এই পরিণতি হত না। আমরা চাই, রাতে কামরায় সব সময়ে পুলিশ পাহারা থাকুক।’’
সাধনা নিজেও এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী ছিলেন কয়েক মাস আগে। তাঁর কথায়, ‘‘একদিন রাতে বাড়ি ফিরছি। এক মহিলা তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে কামরায় ছিলেন। এক যুবক মহিলা কামরায় উঠে পড়ে। কামরায় মহিলাদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েক জন। যুবককে দেখে ওই মহিলা গলা থেকে সোনার চেনটি খুলে নিজের ব্যাগে রেখে দেন। পরের স্টেশনে ঢোকার আগে ট্রেনের গতি কমতেই ছেলেটি আচমকা এক টানে মহিলার ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে কামরা থেকে লাফ মেরে পালায়। আমরা চিৎকার করলেও কেউ শোনার ছিল না। মহিলার সে কী কান্না!’’
করোনা আতঙ্ক ও শীতের কারণে এখন রাত হলেই ট্রেনে ভিড় কমে যাচ্ছে। বিশ বছর ধরে গৃহ সহায়িকার কাজ করেন গাংনাপুরের বাসিন্দা পারুল বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘‘মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। সে সময়ে রানাঘাট থেকে ট্রেন ধরতে খুব ভয় লাগে। ট্রেনে সে ভাবে যাত্রী দেখতে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে মহিলা কামরা কার্যত ফাঁকাই থাকে। যে কারণে সাধারণ কামরায় যাতায়াত করি।’’ তবে তাঁর দাবি, অধিকাংশ দিন রেলপুলিশকে দেখতে পাওয়া যায়। তাঁরা বিভিন্ন কামরায় টহল দেন।
নদিয়ার নবরায়নগরের বাসিন্দা উর্মিলা কীর্তনীয়া বলেন, ‘‘একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করি। মাঝে মাঝে আমারও বাড়ি ফিরতে রাত হয়। বেশ ভয় লাগে। শীত এবং বর্ষার সময়ে বেশি ভয় হয়। সে সময়ে স্টেশনে কার্যত কেউ থাকে না। আরও
বেশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলে ভাল হয়।’’
মহিলারা জানালেন, রাতের মহিলা কামরায় যাত্রী সংখ্যা কম থাকে। করোনা পরিস্থিতিতে সংখ্যা আরও কমেছে। শুক্রবার রাতে ওই তরুণী কামরায় একাই ছিলেন। মহিলাদের কথায়, ‘‘মহিলা কামরায় রাতে উঠতেই ভয় লাগে। পুলিশ না থাকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ওই সময়ে কোনও ছেলে উঠে পড়লে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হয়।’’
কয়েক জন মহিলা যাত্রীর অভিজ্ঞতায়, মহিলা কামরায় ছেলেরা উঠে অনেক সময়ে শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে। রাতে মহিলা কামরায় না উঠে নিরাপত্তার কথা ভেবেই সাধারণ কামরায় উঠতে বাধ্য হন অনেকে।
রানাঘাট-বনগাঁ রেলযাত্রী সুরক্ষা সমিতি সূত্রে জানানো হয়েছে, রাতে রানাঘাট থেকে বনগাঁ যাওয়ার শেষ ট্রেন ১১টা ৯ মিনিটে। তার আগের ট্রেন রাত ৯টা ১০ মিনিটে। অন্য দিকে, বনগাঁ থেকে রানাঘাট যাওয়ার শেষ ট্রেন রাত ১১টা ১২ মিনিটে। তার আগের ট্রেন রাত ৯টা ২ মিনিটে। দু’দিক থেকেই রাতের শেষ ট্রেনের সঙ্গে আগের ট্রেনের ব্যবধান প্রায় ২ ঘণ্টার। সমিতির সম্পাদক শিশির ঘোষ বলেন, ‘‘বনগাঁ-রানাঘাট লোকালে রাতে নিরাপত্তা নেই। রাতে কামরায় সবদিন, সব সময়ে পুলিশ মোতায়েন থাকে না। রাতে শেষ ট্রেন এবং তার আগের ট্রেনের মধ্যে ব্যবধান প্রায় ২ ঘণ্টার। ফলে অনেক মহিলা যাত্রীর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। আমরা রেল কর্তৃপক্ষের কাছে ওই ব্যবধানে আরও একটি ট্রেন চালানোর দাবি জানিয়েছি।’’ তিনি জানান, নতুন করে রাতে ট্রেনের কামরায় সর্বক্ষণ পুলিশ মোতায়নের দাবিও জানানো হবে রেল পুলিশের কাছে।
লোকাল ট্রেনে হকারি করেন কেশব বৈদ্য। তিনি বলেন, ‘‘রাতে সব সময়ে কামরায় পুলিশ থাকে না। আমরাও সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে কামরায় উঠি না।’’
শুক্রবার রাতের ঘটনার পরে অবশ্য রাতের ট্রেনে নিরাপত্তা নতুন করে বাড়ানো হয়েছে বলে জিআরপি জানিয়েছে। জিআরপি ও স্থানীয় সূত্রে জানানো হয়েছে, এতদিন রাতের শেষ ট্রেনে পুলিশ পাহারা থাকত। শনিবার থেকে সন্ধ্যা ৭টার পর সব ট্রেনে, বিশেষ করে মহিলা কামরায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
জিআরপি সূত্রে জানানো হয়েছে, বনগাঁ থেকে রানাঘাটের দূরত্ব প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। অন্য দিকে, বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখায় বনগাঁ থেকে বারাসতের আগে পর্যন্ত প্রায় ৫৭ কিলোমিটার রেলপথ বনগাঁ জিআরপি-র অধীনে। এই দীর্ঘপথে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পুলিশকর্মী মাত্র ২৪ জন। কামরায় নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ থাকে। কামরায় নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পুলিশকর্মীর অভাব আছে।