সোলার আলো হাতে পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র
মেয়ের পড়াশোনার জন্য মোমবাতি কিনে কিনে আর খরচ পোষাতে পারছিলেন না মাধবী পাল।
আমপানের পর থেকে টানা দশ- বারো দিনের মতো বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। স্বামী স্থানীয় হাসপাতালে গ্রুপ ডি স্তরের সরকারি চাকুরে। মাথার উপরে ছাদ থাকলেও মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন মা। ঝড়ের পর থেকেই ঘন ঘন লোডশেডিং চলছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তিতসা পালকে তাই মা হিসাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন দিনের বেলাতেই সব পড়া সেরে রাখতে। কিন্তু এটা যে স্থায়ী সমাধান হতে পারে না, সেটা জানতেন তিনিও।
সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্চের তিতসার মতো আরও অনেকেই একই অবস্থায় রয়েছে। আমপানের পর থেকে পড়াশোনা শিকেয় উঠেছিল ওদের। একে করোনার কারণে দীঘদিনের স্কুলে ক্লাস বন্ধ থাকা। তার উপরে ঝড়, তাতে বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। সঙ্গে টানা বৈদ্যুতিক সংযোগ না থাকায় পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল ওদের। কোনও রকমে দিনের আলো থাকতে থাকতে পড়াশোনা সারছিল সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েগুলি। যারা ২০২১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। এবার সেই আসন্ন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের হাতে সোলার লাইট আর বইখাতা তুলে দেওয়া হল, যাতে তারা নির্ভাবনায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।
রবিবার ‘কোয়রান্টিন স্টুডেন্ট ইয়ুথ নেটওয়ার্ক’ ও সায়েন্স কমিউনিকেটরস ফোরাম’-এর যৌথ উদ্যোগে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের কনকনগর, রূপকুমারি, বাইনাড়া গ্রামের ২০০ জন পড়ুয়ার হাতে সোলার আলো, ব্যাটারি ও খাতা তুলে দেওয়া হয়। ওই সংস্থার সদস্যদের তরফে জানানো হয়েছে আগামী দিনে সুন্দরবন ও রাজ্যের অন্যান্য ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার আরও বেশি সংখ্যক প্রান্তিক পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে যাবেন তাঁরা। যাতে আমপান পরবর্তী বৈদ্যুতিক সংযোগ বা অন্য কোনও ধরনের সমস্যা তাদের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রস্তুতিতে কোনও ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে, তার জন্য পাশে থাকা হবে। ‘কোয়রান্টিন স্টুডেন্ট ইয়ুথ নেটওয়ার্ক’-এর অন্যতম সদস্য মন্মথ রায় এ দিন বলেন, ‘‘এই গ্রামগুলোয় বিদ্যুৎসংযোগ রয়েছে। কিন্তু লোডশেডিংয়ের সমস্যা গুরুতর। বিদ্যুতের উপরে নির্ভর করে যাতে ওরা পড়াশোনায় পিছিয়ে না পড়ে, তাই আমাদের এই ভাবনা।’’
তিনি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার কুমিরমারি, পুঁইজালি, মন্মথনগর, রাঙ্গাবেলিয়া, সাতজেলিয়ায় ২০০ জন পড়ুয়াকে এবং বুধবার হাসনাবাদে আরও ২০০ জন পড়ুয়ার হাতে সোলার আলো ও ব্যাটারি তুলে দেওয়া হবে।
এখন নতুন ভাবে গড়া বাঁধের কারণে জলপ্লাবিত হওয়ার ভয় অনেকটাই কম। তবে গ্রামে গ্রামে ফসল-পচা দুর্গন্ধ। বহু কাঁচাবাড়ি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি এখনও। এ দিন কনকনগর এইচ ডি ইন্সিটিউশনের দশম শ্রেণির ছাত্র পুষ্কর মণ্ডল বলেন, ‘‘আলো পেয়ে খুব সুবিধা হল। আমাদের তো কাঁচাবাড়ি। ঝড়ে খড়ের ছাদ উড়ে গিয়েছিল। ঝড়ের পর বেশ কয়েক দিন বইখাতা নিয়ে বসার মতো অবস্থাই ছিল না। তার মধ্যে কারেন্ট থাকত না বেশির ভাগ সময়ে। আর আমার পরিবারের ব্যাটারি ল্যাম্প কেনার মতো আর্থিক অবস্থাও নয়। এবার দিনের বেলায় সোলার আলো চার্জ করে নিলে রাতে পড়াশোনা করতে ততটা সমস্যা হবে না।’’
তবে অর্থকষ্ট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারি। কাঁচাবাড়ির ঘরে আলো জ্বেলে রোজ সন্ধেয় বই খুলে বসা ছাত্রাবস্থার তপস্যা থেকে বিচ্যুত করা যায়নি ওকে। ওর মতো আরও অনেক প্রান্তিক পড়ুয়াদের।