পাচারের-পথ: ইছামতীর ও দিকে বাংলাদেশ। নদী পেরিয়ে আসে ইলিশ। ইনসেটে, ধৃত পাচারকারী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
সরকারি ভাবে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আসা গত আট বছর ধরে কার্যত বন্ধ। মাঝে মধ্যে সৌজন্যমূলক ভাবে কিছু মাছ রফতানি করে সে দেশের সরকার। কিন্তু পদ্মার ইলিশ থেকে মোটামুটি বঞ্চিত এ পারের ইলিশভক্তেরা।
আর তারই জেরে গত কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে ইলিশ পাচার। বিএসএফ, পুলিশ কিছু কিছু মাছ আটক করে। গ্রেফতার করা হয় পাচারকারীদের। কিন্তু চোরাগোপ্তা ইলিশ মাঝে মধ্যেই ঢোকে বাংলাদেশ থেকে। রাজ্যের বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয় সেই মাছ। যদিও বিএসএফ এবং পুলিশ জানাচ্ছে, যে কোনও ধরনের পাচার রুখতেই তারা সতর্ক আছে।
এ বছর বাংলাদেশ সরকার সামান্য কিছু ইলিশ রফতানির ছাড়পত্র দিয়েছিল। ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে সরকারি ভাবে সেই মাছ এসেছে। পেট্রাপোল বন্দর সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্গাপুজোর আগে বাংলাদেশ থেকে সরকারি ভাবে আরও ১ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন ইলিশ ঢোকার কথা। তবে এ রাজ্যের মানুষের চাহিদার তুলনায় তা নেহাতই সামান্য। সেই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারীরা।
বাংলাদেশ সরকারের যুক্তি, সে দেশের চাহিদা পূরণ করার পরে ভারতে ইলিশ পাঠানো সম্ভব হয় না। ভারতে নিয়মিত ইলিশ রফতানি চলতে থাকলে সে দেশের বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে যায়।
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ইলিশ পাচারের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কী ভাবে পাচার হয় ইলিশ? বিএসএফ, পুলিশ এবং সীমান্ত এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তার নানান কায়দা-কানুন। ভারত-বাংলাদেশের আংরাইলে সীমান্তে কাঁটাতার নেই। দু’দেশের সীমানার মাঝে ইছামতী নদী। এ দেশের যুবক সাঁতারে চলে যায় মাঝ নদীতে। ও পারের বাংলাদেশি যুবক সাঁতরে চলে আসে। হাতবদল হয় ইলিশ ভর্তি ব্যাগ।
আবার, ইছামতীতে সাঁতরে এসে ও পারের যুবক ইলিশ বোঝাই ব্যাগ তুলে দিয়ে যায় এ পারের মাছ ধরা নৌকোয়।
পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাকে করেও ইলিশ পাচার হচ্ছে এ দেশে। এ দেশ থেকে পণ্য-ভর্তি ট্রাক নিয়ে যে সব চালক বেনাপোলে যান, ইলিশ পাচারকারীরা তাঁদের একাংশকে কাজে লাগায়। বেনাপোল থেকে ইলিশ আনলে ট্রাক চালকদের ৫-৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সম্প্রতি বিএসএফ কয়েকজন ট্রাক চালককে গ্রেফতার করে ইলিশ উদ্ধার করেছে।
এ পারের গ্রামের মহিলা-পুরুষেরা সীমান্তে কাঁটাতারের মধ্যে থাকা খেতে ঘাস কাটতে যায়। ও পার থেকে তাদের ছুড়ে দেওয়া হয় ইলিশ বোঝাই ব্যাগ। ঘাসের বস্তায় সেই মাছ নিয়ে সীমান্তরক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে সহজেই গ্রামে ফেরে পাচারকারী। ২০০-৩০০ টাকা পায় এ জন্য। সেই মাছ কয়েক হাত ঘুরে চড়া দামে পৌঁছে যায় বাজারে।
বনগাঁ মহকুমার আংরাইল বর্ণবেড়িয়া, ঝাউডাঙা, ডোবরাপাড়া, তেঁতুলবেড়িয়া, ঘোনার মাঠ, কালিয়ানি, পেট্রাপোল, কুলিয়া, বাঁশঘাটা, বয়রা সীমান্তে দিয়ে ইলিশ এ দেশে ঢুকছে। ইলিশ পাচারকারীরা মূলত কাঁটাতারহীন পথ এবং জলপথ ব্যবহার করে ইলিশ আনার ক্ষেত্রে। বসিরহাট মহকুমার হাকিমপুর, ঘোজাডাঙা, কৈজুরি, পানিতর সীমান্ত দিয়েও ইলিশ ঢোকে। সম্প্রতি বিএসএফ পাচারকারীদের ধরে, বাংলাদেশের গনি, মিরাজ চৌধুরী এবং এখানকার খোকনের নাম পেয়েছে। যারা ইলিশ পাচারের মাথা।
সোনা বা গরু পাচারে যুক্ত লোকজন সচরাচর ইলিশ পাচারের কারবারে মাথা গলায় না বলেই জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। কারণ, খুব বেশি পরিমাণ মাছ আনা সম্ভব হয় না। খুব বেশি লাভও থাকে না। অনেকে লকডাউনে কাজ হারিয়ে ইলিশ পাচার করছে বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। ২০০-৫০০ টাকা দিলেই তাদের দিয়ে কাজ হাসিল হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি গাইঘাটার বাসিন্দা রাজীব দাসকে ইলিশ-সহ ধরে বিএসএফ। জানা যায়, গুজরাতে পাইপ তৈরির সংস্থায় কাজ করত সে। লকডাইনে কাজ হারিয়ে বাড়ি ফেরে। কাজ মেলেনি। ৫০০ টাকার বিনিময়ে ইলিশ পাচারে নেমে পড়ে।
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সরকারি ভাবে ইলিশ আমদানি শুরু হওয়ার পরে চোরাপথে ইলিশ আসার পরিমাণ অনেকটাই কমেছে। মাস দেড়েক আগে চোরাপথে ইলিশ আসছিল পরিমাণে বেশি।’’ এ রাজ্যের ইলিশ আমদানিকারী সংস্থা ‘হিলশা’র সভাপতি অতুলচন্দ্র দাস বলেন, ‘‘সরকারি ভাবে বাংলাদেশ সরকার ইলিশ রফতানি বন্ধ করার ফলে চোরাপথে ইলিশ পাচার বেড়ে গিয়েছে। তার আগে ইলিশ পাচার হত না। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, ইলিশ রফতানি আগের মতো উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক।’’
তবে সীমান্ত বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত অনেকে জানালেন, এ বার তুলনায় মাছ পাচার হচ্ছে কম। কারণ, লকডাউন পরিস্থিতিতে অনেকের হাতে নগদ কম। চড়া দামে ইলিশ কেনার খদ্দের কমেছে। ফলে চোরাপথে ইলিশ এনে লাভ বিশেষ হচ্ছে না।