বিপত্তি: ভাঙাচোরা রাস্তায় বসে গিয়েছে ট্রাকের চাকা। উল্টে পড়েছে মালপত্র। নিজস্ব চিত্র
মুখ্যমন্ত্রী জেলা সফরে গিয়ে একাধিক সভায় স্বাস্থ্যকর্মীদের বার্তা দিচ্ছেন, বাড়িতে কোনও প্রসব নয়। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব একশো শতাংশ করতে হবে। কিন্তু কোথাও কোথাও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পথই এত বেহাল, প্রসূতিদের সে পথে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহস করছেন না পরিবারের লোকজন।
কুলতলি ব্লকের মৈপীঠ পাঁচমাথার মোড় থেকে কিশোরীমোহনপুর প্রায় ১৫ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা এখন এমন, সে পথে সুস্থ মানুষই যাতায়াত করতে গেলে অসুস্থ হওয়ার জোগাড়। প্রসূতি হলে তো অবস্থা আরও চাপের। ওই ব্লকের জয়নগর গ্রামীণ হাসপাতাল মোড় থেকে কিশোরীমোহনপুর পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা। জেলা পরিষদের আওতায় মৈপীঠ পাঁচমাথার মোড় থেকে কিশোরীমোহনপুর প্রায় ১৫ কিলোমিটার রাস্তা বছর কয়েক ধরেই বেহাল। পিচ উঠে কাদা-মাটি বেরিয়ে পড়েছে। তৈরি হয়েছে বড় বড় গভীর গর্ত। তাতে বর্ষার জল জমে ছোট ডোবার আকার নিয়েছে। তাতে প্রায়শই হাঁটুসমান জল জমে থাকে। গাড়ি চালাতে গিয়ে দিশাহারা চালকেরাও।
ওই রাস্তার মধ্যে পড়ে মৈপীঠ বৈকুন্ঠপুর ও ভুবনেশ্বরী পঞ্চায়েত। দুই পঞ্চায়েতে জনসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এলাকার প্রসূতিদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য রয়েছে একজন সুপারভাইজার। আছেন ২১ জন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁদের মাসে প্রায় ৫০-১০০ জন প্রসূতিকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য আনতে হয় জয়নগর গ্রামীণ হাসপাতালে। তাঁদের আনার জন্য রয়েছে নিশ্চয়যান পরিষেবা। কিন্তু বছর দু’য়েক ধরে রাস্তার অবস্থা এতটাই খারাপ, প্রসূতিদের হাসপাতালে আনতে গিয়ে রাস্তায় প্রসব হয়ে যাচ্ছে বলেও শোনা যায়। আশাকর্মীরা একজন প্রসূতিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে পান ৩০০ টাকা। কিন্তু রাস্তায় প্রসব হয়ে যাওয়ায় সে টাকা তো পাবেনই না, উল্টে তা দেখানো হবে ‘বাড়িতে প্রসব’ হিসাবেই।
সমস্যা শুধু সেখানে থেমে নেই। পর পর রাস্তায় প্রসব হয়ে যাওয়ায় সে কথা গ্রামে চাউর হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের লোকজন অনেকে হাসপাতালে পাঠাতে চাইছেন না প্রসূতিকে। রাস্তা যত দিন না সারানো হয়, বাড়িতেই প্রসব শ্রেয় মনে করছেন তাঁরা।
অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরাও বেঁকে বসেছেন ওই পথে যাতায়াত করতে। ওই রাস্তায় যাওয়ার নাম শুনলে অনেকে ফোন কেটে দিচ্ছেন বলেও জানালেন গ্রামের মানুষ।
এতে সমস্যায় পড়েছেন স্বাস্থ্যকর্মী ও আধিকারিকেরা। কারণ, বাড়িতে প্রসব কমাতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত মহকুমাশাসক, ব্লক প্রশাসন ও স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা এ নিয়ে সভা করছেন। অ্যাম্বুল্যান্সে জয়নগর হাসপাতালে যাচ্ছিলেন মৈপীঠ বৈকুন্ঠপুরের অম্বিকানগর গ্রামের প্রসূতি তপতী জানা ও তাঁর পরিবার। রাস্তা বড় গর্ত। গাড়ি আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল। তপতীর বাবা নারায়ণ জানা গাড়িতে বসে গজগজ করছিলেন। এমন রাস্তা দিয়ে যাতায়াত কত বিপজ্জনক, সে কথাই বলছিলেন।
ওই এলাকার স্বাস্থ্যকর্মী দীপ্তি মণ্ডল দে, পুষ্পাঞ্জলি মণ্ডল, দুর্গারানি হালদারের অভিযোগ, প্রসূতিদের পাশে সব সময়ে থাকতে হয় তাঁদের। দরকারে রাত বারোটাতেও পৌঁছে যান বাড়িতে। কিন্তু প্রসবের সময় এলে কেউ আর ওই রাস্তা দিয়ে হাসপাতালে যেতে চাইছেন না।
এলাকার স্বাস্থ্য সুপারভাইজার নির্মলকুমার গায়েন বলেন, ‘‘রাস্তার জন্য শুধু প্রসূতিদের সমস্যা হচ্ছে তা নয়। মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে যেতে গিয়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। দ্রুত রাস্তা সংস্কার না করলে আরও সংকট তৈরি হবে।’’
রাস্তা খারাপের জন্য রোগী আসতে চাইছেন না, সে কথা মেনে নিচ্ছে জয়নগর গ্রামীণ হাসপাতালের বিএমওএইচ সুরজিৎ সেনও। তাঁর কথায়, ‘‘ওই রাস্তাটি সারানো না হলে দিন দিন সমস্যা বাড়বে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষ জানেন।’’
এ বিষয়ে কুলতলি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শ্যামপদ নাইয়া বলেন, ‘‘ওই রাস্তাটির কথা পৈলানে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে তুলেছিলাম। সে সময়ে মুখ্যমন্ত্রী পূর্ত দফতরে আধিকারিকদের রাস্তা করার বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে ছিলেন। কিন্তু আজও কাজ শুরু হল না।’’ কবে কী ভাবে কাজ শুরু করা সম্ভব, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পূর্ত দফতরের আধিকারিকেরা।