—ফাইল ছবি
রেশনের দোকান সামনে লম্বা লাইন। বেশির ভাগই মহিলা। বড় বড় থলেয় ভরে চাল, গম নিচ্ছিলেন তাঁরা। তাদের পিছন পিছন খানিক দূর এগোনো গেল। মহিলারা ব্যাগ হাতে ভ্যানে উঠে সাঁইপালায় মেয়েদের একটি স্কুলের সামনে নামলেন। সেখানে একটি দোতলা বাড়ির নীচের তলায় ঢুকে গেলেন থলে হাতে। খানিকক্ষণ পরে ফিরে এলেন টাকা গুনতে গুনতে। হাতে থলেও ফাঁকা।
রেশনের চাল, গম কোথায় দিয়ে এলেন?
প্রশ্ন শুনে এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকেন মহিলারা। এক সময়ে মুখ খুললেন। তবে বললেন, নাম বলা যাবে না। বেশ, এ বার তো বলুন, চাল-গম গেল কোথায়?
মহিলারা জানালেন, নানা প্রকল্পের কার্ড দিয়ে তোলা এত পরিমাণ চাল, গম, আটা পরিবারের জন্য লাগে না। তাই রেশন তুলে বাড়তি দামে বিক্রি করে দেন। এক মহিলার কথায়, ‘‘এত চাল-গম দিয়ে হবেটা কী? খাবে কে? তাই বাধ্য হয়েই বেচে দিই। তাতে দু’পয়সা হাতেও আসে।’’
এই চাল কিনে ফড়ে বা ব্যবসায়ীরা কী করে? উত্তরটা অজানা নয় গ্রামের মহিলাদেরও। তাঁরা জানালেন, ওই চালই আবার কয়েক হাত ঘুরে চলে যায় সরকারের ঘরে।
কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পে ভর্তুকির চাল-গম নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে বসিরহাটের নানা প্রান্ত থেকে। বিষয়টি অজানা নয় সরকারি আধিকারিকদেরও। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা খাদ্য দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এ ধরনের অভিযোগ আমরাও পাচ্ছি। অসাধু কিছু লোক এ সব করছে।’’ ওই আধিকারিকের মতে, গ্রামের প্রত্যন্ত কোন প্রান্তে কোন মানুষ নিজের জন্য চাল তুলে বিক্রি করে দিচ্ছেন, তা বোঝা শক্ত। তবু নজর রাখা হয়।’’
খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায়, ‘‘গরিব মানুষকে প্রলুব্ধ করে তাঁদের কাছ থেকে কিছু ফড়ে, ব্যবসায়ী সরকারি প্রকল্পের খাদ্যশস্য কিনে নিচ্ছে। বাজারে তা বেশি দামে বিক্রিও করছে। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
খাদ্য দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, কেন্দ্র ও রাজ্যের নানা প্রকল্পে দরিদ্র পরিবারের জন্য সস্তার চাল, গম মেলে। যে কোনও একটি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার কথা এক জনের। কিন্তু নানা ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, একই ব্যক্তি একাধিক প্রকল্পের কার্ড ব্যবহার করে সস্তার চাল-গম তুলছেন রেশন থেকে। আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত দুই ২৪ পরগনার লক্ষাধিক মানুষ, সিঙ্গুরের জমিদাতা কৃষক পরিবার, জঙ্গলমহল এবং চা বাগানের বড় অংশের মানুষ রাজ্য সরকারের পক্ষে মাসিক পরিবার পিছু ২ টাকা কেজি দরে ১৬ কেজি চাল পান। এ জন্য প্রতি বছর সরকার কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে। কিন্তু এত পরিমাণ চাল-গম পরিবারের কাছে অনেক বেশি। সেই ফাঁক গলেই দুর্নীতি ঢুকে পড়ছে।
একই ব্যক্তি ঘুরপথে একাধিক কার্ড বের করে বিভিন্ন প্রকল্পের খাদ্যশস্য তুললেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য দফতরের এক আধিকারিক।
আয়লার চাল, আটা, গম নিয়ে সুন্দরবনে নানা দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন গ্রামের মানুষ। তাঁদের অনেকের কথায়, ‘‘২০০৯ সালে আয়লার জেরে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় বড়সড় ক্ষতি হয়। এরপরে রাজ্য সরকার সস্তার চাল-গমের ব্যবস্থা করে। আয়লার পরে দশ বছর কেটে গেলেও সেই প্রকল্প তা আজও চালু আছে। এই প্রকল্পের সুযোগ নিয়ে একাধিক পরিবার একই সঙ্গে আয়লা এবং অন্তোদয়ের সুবিধা নিচ্ছে। আবার ২০১১ সালে পঞ্চায়েত সমিতি এবং সরকারি কর্মীদের সার্ভে রিপোর্টে নাম না থাকায় কিছু গরিব মানুষ এই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিতও হচ্ছেন।
স্থানীয় মানুষ জানালেন, রেশনের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু ফড়ে। যারা সরকারি প্রকল্পের চাল ৮-১০ টাকা কেজি দরে কিনে নিয়ে খোলাবাজারে ১৮-২০ টাকায় বিক্রি করছে। ওই চালই সরকারি গোডাউন ঘুরে ফের পৌঁছচ্ছে রেশন দোকানে। মাঝখান থেকে কিছু ফড়ে এই কারবার করে বাড়ি-গাড়ি হাঁকিয়ে বসেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষকে ভয় দেখিয়েও বাড়তি চাল-গম কিনে নিচ্ছে তারা।