উদ্যোগ: বৃষ্টির জল থেকে তৈরি পানীয় জল নিচ্ছেন মিশনপাড়ার মহিলারা। নিজস্ব চিত্র।
বিশেষজ্ঞদের মতে দুই ২৪ পরগনায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পর্যাপ্ত। এই বিপুল পরিমাণ মিষ্টি জলকে ব্যবহার করার জন্য কোনও বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা না থাকায় তা অপচয় হয়। সরকারের ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পের মাধ্যমে বৃষ্টি ধরে কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে। যদিও বিরোধীদের দাবি, প্রকল্প রূপায়ণে খামতি থাকায় জলকষ্ট রয়ে গিয়েছে বহু এলাকায় । পরিস্থিতির খোঁজ নিল আনন্দবাজার
হেমনগর থানার ছোট্ট এলাকা মিশনপাড়া। বছরখানেক ধরে এখানেই বৃষ্টির জল বৈজ্ঞানিক উপায়ে ঘরে রেখে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করার কাজ চলছে। পরীক্ষামূলক ভাবে পানীয় জলের একটি প্রকল্প তৈরি করেছেন কলকাতার বাসিন্দা, কর্মসূত্রে আমেরিকায় একটি কলেজের অধ্যাপক অনিন্দ্য রায়-সহ কয়েকজন। এর সাহায্যে নিয়মিত জল পাচ্ছে প্রায় ৫০টি পরিবার।
মিশনপাড়ার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনিন্দ্যবাবু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এই বিশেষ প্রকল্প গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। ঠিক করা হয়, ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার না করে শুধু বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে পানীয় জলে পরিণত করা হবে। সেই মতো ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বড় ছাদের বৃষ্টির জল পাইপের মাধ্যমে একটি জলাধারে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কংক্রিটের জলাধারটিতে প্রায় ২০ হাজার লিটার জল ধরে। দু’তিন ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিপাতেই জলাধার ভরে যায়। ওই জল বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে পানীয় জলে পরিণত করা হয়। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্য সময়ে মিশনের পাশের পুকুর থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে জল তুলে পরিস্রুত করে ব্যবহার করা হয়। প্রকল্পের খরচ ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা।
এখানকার জল ব্যবহার করেন শারতী মণ্ডল, দীপা মণ্ডলেরা। তাঁরা জানান, আগে গরম কালে পানীয় জলের জন্য ভোরবেলা উঠে বহু দূর যেতে হত। সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে এক কলসি জল নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। এ বছর গরমে জলকষ্ট ভোগ করতে হয়নি। এই জল খেতেও ভাল।
অনিন্দ্য বলেন, ‘‘আমরা মূলত মডেল হিসেবে দেখাতে চেয়েছি, এ ভাবেও পানীয় জলের সমস্যার সমাধান হতে পারে। সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তে এই ধরনের আরও প্রকল্প করার চেষ্টা করব আমরা।’’
প্রকল্পের আর এক উদ্যোক্তা কুণাল দেব বলেন, ‘‘এই প্রকল্প এমন ভাবেই করা হয়েছে, যাতে বন্যা পরিস্থিতিতেও পানীয় জল পেতে সমস্যা না হয়। প্রকল্পের দেখভালের খরচ বছরে ২-৩ হাজার টাকা। স্থানীয় পরিবারগুলি মিলে চাঁদা দিলেই ওই টাকা উঠে আসে।’’ এ বিষয়ে কালীতলা পঞ্চায়েতের প্রধান দীপ্তি মণ্ডলের স্বামী শ্যামল বলেন, ‘‘এই প্রকল্পের ফলে বেশ কয়েকটি পরিবারের জলকষ্ট মিটেছে।’’
কালীতলা পঞ্চায়েতের সামসেরনগর-সহ বিভিন্ন গ্রামে বহু বছর ধরে সারা বছরই পানীয় জলের সমস্যা প্রবল। গরমকালে সমস্যা আরও বাড়ে। বহু এলাকায় পাইপলাইনে জল সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বৈজ্ঞানিক উপায়ে বৃষ্টির জল ধরে রেখে ব্যবহার করা গেলে পানীয় জলের সমস্যা অনেকটা মেটানো সম্ভব।
আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির রাজ্য সম্পাদক অশোক দাস বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এই বিপুল পরিমাণ মিষ্টি জলকে ব্যবহার করার জন্য কোনও বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা না থাকায় তা অপচয় হয় এবং কখনও কখনও তা বন্যার সৃষ্টি করে।’’
বৃষ্টির জলকে ধরে রেখে ব্যবহারের জন্য ২০১১-১২ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালু করেন ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প। এর মূল কথা হল, ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার কমিয়ে বৃষ্টির জল সঞ্চয়ে জোর দেওয়া। জলাধার বা পুকুরে বৃষ্টির জল ধরে রাখা। এটি রূপায়িত হলে সারা বছর ধরে পানীয় জল হিসেবে তা ব্যবহার করা যাবে। আবার ওই জলের কিছুটা চুঁইয়ে যাবে ভূগর্ভে। এর ফলে ভূগর্ভে জলের ভারসাম্য রক্ষা হবে। প্রকল্প অনুযায়ী দুই ২৪ পরগনায় কিছু কিছু কাজও হয়েছে।
সন্দেশখালির বিডিও সুপ্রতিম আচার্য ও হিঙ্গলগঞ্জের বিডিও শাশ্বতপ্রকাশ লাহিড়ী জানান, বৃষ্টির জল ধরে রেখে চাষের কাজে ব্যবহারের জন্য পুকুর, খাল কাটা হয়। ব্লকের কয়েকটি জায়গায় সরকারি ভবনের ছাদ কাজে লাগিয়ে বৃষ্টির জল ধরে তা পানীয় জলে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সুমিত গুপ্তা বলেন, ‘‘জল ধরো জল ভরো প্রকল্পের সঙ্গে একশো দিনের কাজ প্রকল্পকে যুক্ত করে পুকুর খনন, পুকুর জলাশয় সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে।’’ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, গত ২০ নভেম্বর থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত জেলার ২২টি ব্লকে ১০৬৮টি পুকুর খনন করা হয়েছে। খরচ হয়েছে প্রায় ২৯ কোটি টাকা।
দক্ষিণের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, ক্যানিং, বাসন্তী, গোসাবা, ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ ব্লকে প্রতি বছর পুকুর ও খাল সংস্কারের কাজ করা হয়। বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা দিয়ে চাষের কাজ করা হয়। গোসাবায় চাষের কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি খালের জল পরিস্রুত করে পানীয় জলের অভাবও মেটানো হয়।
তবে খাতায়-কলমেই সরকারি কাজ হয়, বাস্তবে মানুষের খুব একটা লাভ হয় না বলে দাবি বিরোধীদের। দক্ষিণ ২৪ পরগনা বিজেপির পূর্ব সাংগঠনিক জেলার সভাপতি সুনীপ দাস বলেন, ‘‘এখনও প্রতি বছর শীতের শেষ থেকেই বর্ষার আগে পর্যন্ত মানুষকে প্রবল জলকষ্টে কাটাতে হয়। সঠিক ভাবে প্রকল্প রূপায়ণ হলে ভূগর্ভস্থ জলের ভাঁড়ারে এ ভাবে টান পড়ত না।’’ (শেষ)