সরকারি প্রচার চলে সারা বছর ধরে। স্কুলে তৈরি হয়েছে কন্যাশ্রী ক্লাব। তারাও চেষ্টা করে নাবালিকা বিয়ে বন্ধের। এত সবের পরেও মাঝে মধ্যেই নাবালিকা বিয়ের খবর পৌঁছয় পুলিশ-প্রশাসনের কাছে। কখনও কখনও শেষবেলায় হাজির হয়ে বিয়ে আটকানো হয়। অনেক সময়ে এ কাজে গিয়ে আক্রান্ত হন সরকারি কর্মীরা। পরিস্থিতির খোঁজ নিল আনন্দবাজার
Child Marriage

নাবালিকার বিয়ের দিনই কেন পদক্ষেপ, উঠছে প্রশ্ন

ক্যানিংয়ের বাসিন্দা সুরজিৎ রায়, বাসন্তীর বাসিন্দা লিপিকা মণ্ডল, গোসাবার বাসিন্দা ননীগোপাল সর্দারদের মতে, পুলিশ আর একটু তৎপর হলে বিয়ের আগেই সেটা বন্ধ করা সম্ভব।

Advertisement

প্রসেনজিৎ সাহা

ক্যানিং শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২২ ০৯:৫২
Share:

প্রতীকী ছবি।

নাবালিকা বিয়ে বন্ধের জন্য নানা ভাবে উদ্যোগী প্রশাসন। তারপরেও চোরাগোপ্তায় অল্পবয়সি মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন পরিবার-পরিজন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের দিনই খবর পৌঁছয় প্রশাসনের কানে। বিয়ের আসরে গিয়ে তা বন্ধ করতে পদক্ষেপ করা হয়। বহু অভিভাবকের বক্তব্য, নাবালিকা বিয়ে অপরাধ, তাঁরা জানতেন না। সব আয়োজন হয়ে যাওয়ার পরে ছাদনাতলায় পুলিশকে দেখে অনেকেই অনুরোধ করেন, চারহাত এক করতে দেওয়া হোক। মেয়ে না হয় আপাতত বাপের বাড়িতেই থাকবে। হঠাৎ সব আয়োজন শেষ হওয়ার পরে বিয়ে বন্ধ হলে বহু টাকার লোকসান। প্রথা মেনে, মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা হবে না তো, সে প্রশ্নও তোলেন বাবা-মায়েরা।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে পরিবারের লোকজনকে বোঝাতে বিস্তর বেগ পেতে হয় পুলিশ-প্রশাসন, চাইল্ড লাইনকে। প্রশ্ন উঠছে, এ ধরনের খবর কেন বিয়ের কয়েকদিন আগে পৌঁছচ্ছে না প্রশাসনের কানে। তা হলে বিয়ের আয়োজন সমাধা হওয়ার আগেই আটকানো যাবে বিয়ে। হয়রানি কম হবে সব পক্ষের।

ক্যানিংয়ের বাসিন্দা সুরজিৎ রায়, বাসন্তীর বাসিন্দা লিপিকা মণ্ডল, গোসাবার বাসিন্দা ননীগোপাল সর্দারদের মতে, পুলিশ আর একটু তৎপর হলে বিয়ের আগেই সেটা বন্ধ করা সম্ভব। অতিথি-অভ্যাগতেরা এসে পড়ার পরে বিয়ে বন্ধ করতে ঝকমারি প্রচুর। এ কথা ঠিক, গরিব পরিবারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টিও সহানুভূতি নিয়ে দেখা উচিত।

Advertisement

নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে একটি সংস্থা। গরানবোসের ওই সংস্থার আধিকারিকদের দাবি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুঃস্থ, অসহায়, অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত পরিবারেই মেয়েদের আঠারো বছরের কমে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাড়ির মেয়ে একটু বড় হলেই পাত্র খোঁজা শুরু হয়ে যায় এ সব পরিবারে। পড়াশোনাও বন্ধ করে দেওয়া হয় মেয়ের। সংস্থার সহ সম্পাদক কাকলি দাস বলেন, “নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে আমরা বাসন্তী ব্লকে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। ইয়ুথ গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকায়। ২৫টি গ্রুপের সদস্যেরা বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। নাবালিকা বিয়ের খবর পেলেই তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে এটা বন্ধ করতে পারেন। না হলে প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়ার পথ তো আছেই।” লকডাউনে ইয়ুথ গ্রুপের সদস্যেরা বাসন্তীতে অন্তত ৪০ জন নাবালিকার বিয়ে আটকাতে পেরেছে বলে দাবি কাকলির। তিনি আরও বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বিয়ের উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত করা। প্রথমে নাবালিকা ও তার পরিবারের লোকজনকে বোঝানো হয়। সেই মুহূর্তেই যাতে বিয়ের উদ্যোগ বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে কথা শুরু হয়।”

প্রশাসন সূত্রের খবর, নাবালিকা বিয়ের খবর পেলেই দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে তা বন্ধ করার উদ্যোগ করা হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের দিন বিষয়টি সামনে আসে বলেই দাবি তাঁদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্লক প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, “আসলে অনেকেই জেনেশুনে বিয়ে দেন নাবালিকা মেয়ের। ফলে অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। যখন বিষয়টি আশপাশের মানুষ জানতে পারেন, তখনই তাঁরা চাইল্ড লাইন বা স্থানীয় প্রশাসনকে জানান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের দিন বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। তাই আমাদের ইচ্ছে থাকলেও আগে জানতে না পারায় সমস্যা হয়।’’

প্রশাসনের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছর ক্যানিং ১ ব্লকে অন্তত ৩৫ জন, বাসন্তী ব্লকে অন্তত ৭০ জন এবং গোসাবা ব্লকে ৪ জন কিশোরীর বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে প্রশাসনের উদ্যোগে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করা হয়েছে বিয়ের দিন।

নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে স্কুলে স্কুলে কন্যাশ্রী ক্লাব গঠন করার কথা। জেলার বেশ কিছু স্কুল এ বিষয়ে কাজও করছে। মথুরাপুরের কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি বলেন, “আমরা গুরুত্ব দিয়ে এই কাজ করি। প্রতিটি সেকশনের চারজন করে পড়ুয়া রয়েছে কন্যাশ্রী ক্লাবে। প্রতি শনিবার এদের নিয়ে আমরা মিটিং করি স্কুলে। গ্রামের কোথায় কার বিয়ের ঠিক হচ্ছে, তা খোঁজ নিয়ে দ্রুত বন্ধের জন্য পদক্ষেপ করা হয়। গত এক বছরে চল্লিশটির বেশি নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করেছে আমাদের কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরা।”

তবে কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুল গুরুত্ব দিয়ে কাজ করলেও জেলার বেশিরভাগ স্কুল সে ভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ। চন্দন বলেন, “নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে ভিলেজ লেভেল কমিটি, ব্লক লেভেল কমিটি রয়েছে। কিন্তু এরা কেউই সে ভাবে সক্রিয় নয়। যদি হত, তা হলে এ ভাবে নাবালিকা বিয়ের ঘটনা ঘটত না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement