এই ঘরেই খুন করা হয় জইনুল হককে (ইনসেটে)। নিজস্ব চিত্র
কাকভোর কিংবা গভীর রাত, যখন-তখন গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে মহল্লা। কামারহাটির গঙ্গার পাড় ঘেঁষা পাড়ায় নোংরা জলে ভরা তস্য গলির ঘুপচি ঘরে কিংবা আলো-বাতাস না খেলা বহুতলের ছাদে বৈঠকে ঠিক হয় পরের ‘খাল্লাস’-এর নাম। স্থানীয়েরা জানান, এখানে সামান্য কথা কাটাকাটিতেও কোমরে গোঁজা পিস্তল বার করে খাল্লাস করে দিতে হাত কাঁপে না কোনও যুবকের। ঠিক যেমনটা হয়েছে বুধবার স্বাধীনতা দিবসের রাতে। ক্যারম খেলা নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে, উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটিতে খুন হতে হয় বছর বিরাশির এক বৃদ্ধকে।
ওই রাতে ১০টা ২০ নাগাদ আচমকা এক বিকট শব্দে বৃষ্টি ভেজা তস্য গলির নিস্তব্ধতা ভাঙে। স্থানীয়েরা জানান, তুঁত বাগান এলাকার ওই গলির মোড়ে দাঁড়ানো কয়েক জন ছুটে গিয়ে দেখেন, বস্তির ঘুপচি টালির ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ছোট্ট সোফায় বসা বৃদ্ধ জইনুল হক এক দিকে কাত হয়ে পড়ে। তাঁর গলা এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দিয়েছে গুলি। সঙ্গে সঙ্গে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
পুলিশ জানায়, কামারহাটির ম্যাকেঞ্জি রোডের পাশের তুঁত বাগানে গলির এক পাশে সার দিয়ে রয়েছে টালির ঘর। সেখানেই ন’ফুট বাই দশ ফুটের একটি ঘর জইনুলের। অবসরের পরে বাড়ির পিছনেই একটি ‘ক্যারম-পার্লার’ খুলেছিলেন তিনি। বয়সের ভারে অশক্ত জইনুল রোজ লাঠিতে ভর দিয়ে দোকানে আসতেন। পাড়ার ছেলেরা মাথাপিছু ঘণ্টায় ১০ টাকা দিয়ে খেলায় অংশ নিতেন সেখানে।
স্থানীয়েরা জানান, বুধবার রাতেও সেখানেই খেলছিলেন দুই যুবক। ঘরের ভিতরেই বসেছিলেন বৃদ্ধ জইনুল। তখনই ওই দোকানে এসে ঢোকে স্থানীয় যুবক আফসার আলি ও ছোট্টু। অভিযোগ, দুই যুবককে খেলা বন্ধ করতে বলে ওই দু’জন। দাবি করে, তাদের খেলার জন্য বোর্ড ছেড়ে দিতে হবে অন্যদের। প্রতিবাদ করতেই আফসারদের সঙ্গে বচসা বেধে যায় জইনুলের। কথা কাটাকাটির মাঝেই আফসার কোমরে গোঁজা পিস্তল বার করে ওই বৃদ্ধের গলায় গুলি চালিয়ে দেয়। এর পরেই চম্পট দেয় ওই দুই দুষ্কৃতী। পরে রাতে ওই দু’জনকে গ্রেফতার করে বেলঘরিয়া থানার পুলিশ। মৃত বৃদ্ধের ভাই আনারুল হক বলেন, ‘‘সামান্য কথা কাটাকাটিতে কেউ কাউকে মেরে দিতে পারে, এটা ভাবতেও পারছি না।’’
ঘটনায় অবাক স্থানীয় কাউন্সিলর আফসানা খাতুন থেকে শুরু করে পাশের ওয়ার্ডের পুর প্রতিনিধি শামা পারভিন। তাঁদের বক্তব্য, এলাকায় দুষ্কৃতীরাজ বেড়ে চলেছে। এটা মানা যাবে না। শান্তি ফেরাতে মানুষের প্রতিবাদ করা দরকার। বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিবাদ-আন্দোলন করেও শোধরায়নি কামারহাটির ১ থেকে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এই এলাকা। স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকার দুই ‘দাদা’র পুরনো শত্রুতাই এখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। শাসকদলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ওই দুই দলের ছেলেরাই নিজেদের জোর প্রমাণ করতে এলাকায় ত্রাস তৈরি করে। স্থানীয় এক যুবক জানান, এক বাক্স বিরিয়ানির বিনিময়েও এখানে ‘সুপারি কিলার’ পাওয়া যায়। কয়েক দিন আগে এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানা মিলেছে। বহু যুবকই এখানে প্রকাশ্যে পিস্তল নিয়ে ঘোরে। আবার পিস্তল হাতে প্রাক্তন বিধায়ক মদন মিত্রের নাম নিয়ে জয়ধ্বনিও দিতে দেখা গিয়েছে কয়েক জনকে। মদনবাবুর যদিও দাবি, তাঁর বদনাম করতেই এ সব হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘আমার নাম করে যদি কেউ পিস্তল নিয়ে ঘোরে, তাকে গ্রেফতার করতে হবে। আমি বিধায়ক হয়ে সব বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আবার শুরু হয়েছে। মানুষ শান্তি চান, মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে অনুরোধ করব, পুলিশ যেন তল্লাশি করে আগ্নেয়াস্ত্র বাজেয়াপ্ত করে।’’ ব্যারাকপুরের এক পুলিশকর্তার দাবি, এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। সব সময়েই নজর রাখা হয়। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।