ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী।
রাজ্য জুড়ে যখন করোনার প্রকোপ ভয়াবহ, টানা লকডাউন চলছে সর্বত্র, তখন বসিরহাটের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে কখনও অক্সিজেন সিলিন্ডার, কখনও বা খাবার নিয়ে ছুটে গিয়েছেন তিনি। বহু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
অথচ, একটা সময়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ যেতে বসেছিল বসিরহাট পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের মৈত্রবাগানের বাসিন্দা ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী ওরফে অলোকের। দু’টি হাত বাদ পড়ে। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকু ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে যখন জীবনযুদ্ধে হেরে হতাশা গ্রাস করছে, তখন কয়েকজনকে পাশে পান ইন্দ্রজিৎ। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে দু’টি রোবোটিক হাত পেয়ে ফের জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়েছেন তিনি। এখন ছোটখাট ব্যবসা করেন।
দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০২০ সালের ৪ জুন। তখন কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন ইন্দ্রজিৎ। বসিরহাট এলাকায় কাজে গিয়েছিলেন। তিনতলায় বাঁশের মাচায় উঠে কাজ করার সময়ে পাশে থাকা ১১ হাজার ভোল্টের তারের সংস্পর্শে এসে ছিটকে যান। ঝুলতে থাকেন। বাঁশ দিয়ে ধাক্কা মেরে উঁচু থেকে তাঁকে নীচে ফেলা হয়েছিল। সারা শরীর ঝলসে যায়। পিজি হাসপাতালে প্রায় সাতদিন পরে জ্ঞান ফিরলে দেখেন, কনুইয়ের নীচ থেকে বাঁ হাতটা আর নেই।
ভেবেছিলেন, ডান হাতটা দিয়ে বাকি জীবনটুকু চালিয়ে নেবেন। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা ইন্দ্রজিৎতের প্রাণ বাঁচাতে ডান হাতটিও চিকিৎসকেরা বাদ দিতে বাধ্য হন। পায়ের বেশ কিছুটা অংশের মাংস পচে গিয়েছিল। খুলিতে সংক্রমণ ছড়ায়। দরিদ্র পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ইন্দ্রজিতের এ হেন পরিস্থিতিতে গোটা পরিবার কার্যত অসহায় হয়ে পড়ে। বয়স্ক মা সুচিত্রা চৌধুরী সংসার চালানোর জন্য হোটেলে রান্নার কাজ বেছে নেন। স্ত্রী সুষমা সারাক্ষণ স্বামীর চিকিৎসা ও দেখভালের কাজ করতেন। কেটে যায় কয়েক মাস। সাতবার অস্ত্রোপচার হয়।
২০২১ সালের গোড়ায় ইন্দ্রজিতের কথা জানতে পারে বরাহনগরের সংস্থাটি। সংস্থার সদস্য জয়ন্ত চক্রবর্তী তাঁকে নতুন করে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান কলকাতায়। বেশ কিছুদিন কলকাতায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা চলে। কিন্তু সে ভাবে কোনও উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি।
সংস্থার সদস্য স্বপ্না চৌধুরীর মাধ্যমে খোঁজ মেলে সেকেন্দ্রাবাদের বাসিন্দা দেবোপম চক্রবর্তী ও অদিতি চক্রবর্তীর। তাঁদের মাধ্যমে হায়দরাবাদে রোবট অর্থোকেয়ার সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ হয় বরাহনগরের সংস্থার লোকজনের। ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে।
চিকিৎসকেরা জানান, ১০০ শতাংশ না হলেও নিজের অনেকটা কাজ নিজেই করতে পারবেন ইন্দ্রজিৎ, যদি রোবোটিক হাত লাগানো হয়। নতুন করে আশার আলো দেখেন যুবক। অবশেষে কৃত্রিম হাত পান তিনি। নতুন করে নিজের হাতে জল খাওয়া, লেখালিখি, ফোন ধরার মতো টুকটাক কাজও নতুন করে শিখতে হয় ইন্দ্রজিৎকে।
স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতেই শুরু করেছেন পরিবেশবান্ধব কাগজের পেন তৈরির ব্যবসা। সেই পেন ইতিমধ্যে জেলা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্তরে বিক্রির জন্য পাঠাতে শুরু করেছেন। মাথার ক্ষত এখনও সারেনি। চিকিৎসার জন্য প্রতি সপ্তাহে এসএসকেএম হাসপাতালে যেতে হয়।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য পৌষালি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ওঁর পাশে আছি। কিন্তু দিনের পর দিন লড়াইটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সত্যিই ভবিষ্যতে কী হবে জানি না। তবে ইন্দ্রজিৎ সহজে ছাড়ার পাত্র নন। আমরাও পাশে আছি।’’ ইন্দ্রজিৎ বলেন, “মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। নিজে কিছু করতে পারার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তবে এখন নতুন করে বাঁচতে চাই। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই।”
ইন্দ্রজিতের স্ত্রী বলেন, “বরাবরই স্বাধীনচেতা মানুষ। শারীরিক অক্ষমতা ওঁকে আটকাতে পারবে না জানি।”