পুলিশের ভূমিকায় ভরসা রাখতে পারছে না মানুষ। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
শুরুটা হয়েছিল ১৯ মে। তারপরে আরও একটা ১৯ তারিখ পার হয়ে গিয়েছে। তিন দিন পরে আসছে আর একটা ১৯ তারিখ। কিন্তু ১৯ মে ভাটপাড়া যেখানে ছিল, ভাটপাড়া-কাঁকিনাড়ার বাসিন্দারা বলছেন, ১৫ জুনের অবস্থা তার থেকেও খারাপ। সাধারণ মানুষ রাস্তাতে বেরোতে ভয় পাচ্ছেন। আর বাড়ির বাইরে বেরোলে যে অক্ষত শরীরে বাড়ি ফিরতে পারবেন, এমন ভরসাটুকুই উবে গিয়েছে আমজনতার মন থেকে।
শিক্ষায় আঁধার
সপ্তাহে দু’দিন অফিস কামাই করতে হয় রাজেশ পাসোয়ানকে। আর দু’দিন কামাই করেন তাঁর ছেলে রঞ্জিত। তা না হলে আর এ বার মাধ্যমিকে বসা হবে না সুনয়না পাসোয়ানের। কাঁকিনাড়ায় গোলমাল হওয়া ইস্তক আর স্কুলমুখো হতে পারেনি সে। টিউশন নিতে গেলেও সঙ্গে হয় বাবা নয় দাদাকে সঙ্গে যেতে হয়। তবে সব দিন বাড়ি থেকে বের হতে পারে না মেয়েটি। পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সুনয়নার প্রশ্ন, ‘‘শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিকটা দিতে পারব তো? এমন অবস্থা থাকলে বাড়ি থেকে বেরোবো কী করে?’’ সুনয়নার প্রশ্নের শেষ নেই। ‘‘স্কুল বন্ধ থাকলে টেস্ট পরীক্ষা কী করে হবে?’’ নাগাড়ে প্রশ্ন করেই যায় সে। সুনয়না একটা উদাহরণ মাত্র। কাঁকিনাড়ায় ঘরে ঘরে এখন একটাই প্রশ্ন। চলতি গোলমালের মধ্যে ২০ জুন গুলিতে দুই ফুচকা বিক্রেতার মৃত্যু হয়েছিল। তারপর থেকে এলাকা গোলমালের পারদ ক্রমশ চড়েছে। এলাকার সব স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। দিন দশেক পর স্কুল ফের খোলে। কিন্তু অভিভাবকেরা পড়ুয়াদের পাঠাতে সাহস পাচ্ছিলেন না। সপ্তাহখানেক আগে সেই ভয় অনেকটাই কাটে। এলাকার পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়। শুক্রবার পুলিশের গুলিতে দুষ্কৃতীর মৃত্যুর পরে এলাকা উত্তপ্ত হতে শুরু করে। শনিবার রাত থেকে বোমাবাজি শুরু হয়। সোমবার সকালে বোমাবাজির পরে এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয় ফলে কবে এলাকায় শান্তি ফিরবে কেউ জানে না।
কোপ ব্যবসায়
একটা ইদ পার হয়ে আরও একটা ইদ আসতে চলেছে। মন ভাল নেই বিশাল সিংহের। গত দু’মাস ধরে বন্ধ তাঁর পোশাকের দোকান। মাঝে কয়েকটা দিন দোকান খুললেও খদ্দের পাননি। বললেন, ‘‘মানুষ বাড়ি থেকে বেরোতেই ভয় পাচ্ছেন। এখন এলাকার যা অবস্থা, তাতে আগে লোকে খাবারের জোগাড় করছে। পোশাক কে কিনবে?’’ তবে গত চার-পাঁচ দিন ধরে তবুও বিক্রিবাটা কিছু হচ্ছিল বলে জানালেন বিশাল। কিন্তু সোমবারের ঘটনার পরে কবে ফের এলাকা স্বাভাবিক হবে, তাই ভাবছেন বিশালের মতো অন্যান্য ব্যবসায়ীরা।
তাল কাটছে চটকলে
এমন আর মাসখানেক চললে বাড়ির সদস্যদের খাবার যোগাড় করতে পারবেন কিনা, নিশ্চিত নন রঘু যাদব। আদতে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা রঘু কাঁকিনাড়া জুটমিলের কর্মী। গত দু’ মাসে অন্তত ২৫-২৬ দিন তিনি কাজে যেতে পারেননি। ফলে রোজগারে টান পড়েছে। শুধু তিনি নন, গোলমালে পড়ে চটকলের অনেক শ্রমিকেরই পকেট ফাঁকা। সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাঁদের। রঘু বলছেন, ‘‘রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, তাতে সব দিন বাড়ি থেকে মিলে যাওয়ার সাহস পাই না। আমাদের সহকর্মী বোমার ঘায়ে জখমও হয়েছেন। ছোট দুই ছেলে-মেয়েকে স্ত্রী বাড়িতে একা থাকে। ফলে ওদেরও একা রেখে যেতে পারি না।’’ রঘু জানান, এমন চলতে থাকলে তাঁকে পরিবার নিয়ে নিজের মুলুকে ফিরতে হবে।
আঘাত অন্যত্রও
টোটো চালিয়ে সংসার চালাতে হয় আব্বাস শেখকে। কিন্তু, প্রায় দু’মাস ধরে টোটো ঘরেই পড়ে রয়েছে। তার ফলে সংসারে অনটন শুরু হয়েছে। কোনও পথ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত লোকাল ট্রেনে পাঁপড় বেচতে শুরু করেছেন তিনি। এক সময়ে তাই করতেন। কিন্তু টোটো চালিয়ে রোজগার বেশি হবে বলে ধারদেনা করে টোটো কিনেছিলেন। ছ’মাস যেতে না যেতে স্তব্ধ কাঁকিনাড়া। বছর বত্রিশের আব্বাস বলেন, ‘‘দেনা শোধ করব কী, পেট চালাতেই তো অবস্থা দফারফা হয়ে যাচ্ছে। দিনেদুপুরে রাস্তায় যেমন বোমা পড়ছে। তাতে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না।’’
তছনছ জনজীবন
বন্ধ দোকান। রোজকার আনাজের বাজারও বসছে না। স্বাভাবিক ভাবেই পদপদে ঠোক্কর খেতে হচ্ছে গেরস্থদের। প্রয়োজনের আনাজ, চাল-ডাল কিনতেও যেতে হচ্ছে নৈহাটি নয় জগদ্দলে। কিম্তু তাতেও সমস্যা। ব্যারাকপুর থেকে কাঁচরাপাড়া থেকে যাওয়ার একমাত্র ৮৫ নম্বর রুটের বাস বন্ধ ছিল মাসখানেকেরও বেশি সময় ধরে। নতুন কর চালু হলেও সোমবার থেকে ফের বন্ধ সেই বাস। চলছে না অন্যান্য যানবাহন। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে গেলে ট্রেনই ভরসা। আবার স্টেশন যেতে হলেও মিলছে না টোটো-রিকশা। সেখানে ভরসা সাইকেল বা বাইক। ভাটপাড়ার বাসিন্দা সুপ্রভাত সরকার বলেন, ‘‘আমি কলকাতায় চাকরি করি। ফেরার পথে শিয়ালদহ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ফিরছি।’’