Barasat Child Theft Rumor

মিথ্যে বলেও শেষরক্ষা হল না, বালকের খুনি জেঠুই, বারাসতে গুজব ছড়ানোর মূলপাণ্ডাও সেই আঞ্জিব

বারাসতে ছেলেধরা গুজব ছড়ানোর মূলপাণ্ডা আঞ্জিব নবিই। সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিবাদের জেরে যে আঞ্জিবের হাতেই খুন হয়েছে তাঁর বালক ভাইপো। রবিবার সে কথাই জানালেন বারাসতের পুলিশ সুপার।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

বারাসত শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪ ২০:২২
Share:

অভিযুক্ত আঞ্জিবকে নিয়ে (মুখ ঢাকা) সাংবাদিকদের মুখোমুখি পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়া। — নিজস্ব চিত্র।

সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের জেরেই ভাইপোকে খুন করেছেন জেঠু। তার পর পুলিশকে ধোঁকা দিতে পরিকল্পনা করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, এলাকায় ছেলেধরার উপদ্রবের মনগড়া কাহিনি। স্থানীয় মসজিদে গিয়ে গ্রামবাসীদের সতর্ক করে বলা হয়েছিল, বাইরের লোক দেখলেই মারধর করতে হবে। কিন্তু এত কিছু করেও শেষরক্ষা হল না। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের কাজিপাড়ায় ১১ বছরের বালক তথা ভাইপো ফারদিন নবির খুনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া গেল না। রবিবার বারাসতের পুলিশ সুপার জানিয়ে দিলেন, ভাইপোকে খুন করেছেন জেঠু আঞ্জিব নবিই। পাশাপাশি, পুলিশ আরও জানিয়েছে, জেলা জুড়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির একের পর এক যে ঘটনা ঘটে চলেছে, তা আঞ্জিবেরই মস্তিষ্কপ্রসূত।

Advertisement

উত্তর ২৪ পরগনায় লাগাতার গণপিটুনির ঘটনার পিছনে কে? এই প্রশ্নই এতদিন ভাবাচ্ছিল পুলিশ প্রশাসনকে। রবিবার বারাসতের পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়া জানিয়ে দিলেন, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের জেরে ভাইয়ের ছেলেকে খুন করার পর ঘটনা ধামাচাপা দিতে এবং পুলিশকে ভুল পথে চালিত করতে ধৃত আঞ্জিবই মনগড়া ছেলেধরার গল্প ফেঁদেছিলেন। মসজিদে আজান দেওয়ার কাজ করতেন আঞ্জিব। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি নমাজ শেষের পর গলায় ছদ্ম উত্তেজনা এনে এলাকাবাসীকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, এলাকায় ছেলেধরা ঘুরছে। তাই বাইরের কাউকে দেখলেই মেরে তাড়াতে হবে। ৯ জুন ফারদিন নবি নামে বালক নিখোঁজ হয়। ১৩ জুন, বাড়ির পাশে অন্য একটি বাড়ির পরিত্যক্ত শৌচাগার থেকে তার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। পুলিশ জানাচ্ছে, এত গরমে দেহে পচন ধরেছিল। পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, আঞ্জিব সেই দেহ দেখিয়েই পাড়া প্রতিবেশীদের বলতে থাকেন, ফারদিনের কিডনি কেটে বার করে নেওয়া হয়েছে, চোখ খুবলে নেওয়া হয়েছে। আর এ সবই এলাকায় খুব সম্প্রতি থাকতে আসা দুই মহিলার কাজ। স্বভাবতই, এলাকাবাসীর নজর ঘোরাতে এই কৌশল কাজে দেয়। নিজের অপকর্ম ঢাকতে আঞ্জিব যে গল্প ছড়িয়ে দেন, তা হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে গোটা জেলায়। কিছুই না জেনে তার শিকার হন একাধিক মানুষ। ছেলেধরার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মা, বাবারা। বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়ে যায় গণপিটুনির ঘটনা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। হাটে আঞ্জিবের হাঁড়ি ভেঙে দিল বারাসত পুলিশই।

পুলিশ সুপার জানাচ্ছেন, পৈতৃক সম্পত্তির বাঁটোয়ারা নিয়ে ফারদিনের বাবা গোলামের সঙ্গে দাদা আঞ্জিবের দীর্ঘদিনের সমস্যা। গত ৭ জুন একটি তালগাছের ফল ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ভাইয়ে-ভাইয়ে বাদানুবাদ হয়েছিল। সেই সময় বালক ফারদিন নাকি আঞ্জিবের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সেই থেকে ভাইপোর উপর রাগ আঞ্জিবের। আঞ্জিব পরিকল্পনা করতে শুরু করেন, কী করে তিনি ভাই বা ভাইপোকে দুনিয়া থেকে সরাবেন। ভাই প্রাপ্তবয়স্ক কিন্তু ভাইপো বালক। তাই আঞ্জিব প্রথমে ফারদিনকে খুনের ছক কষেন। পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, যে কাপড়ে ঝুলন্ত অবস্থায় ফারদিনের দেহ উদ্ধার হয়, সেই কাপড়টি সংগ্রহ করে আগেই নিজের ব্যাগে পুরে রেখেছিলেন আঞ্জিব। তার পর ৯ জুন, রবিবার ফারদিনকে বাড়ির পিছনে নিয়ে যান আঞ্জিব। গলা টিপে খুন করেন ভাইপোকে। ফারদিনের নিথর দেহ পাশের বাড়ির পরিত্যক্ত শৌচাগারে এমন ভাবে ঝুলিয়ে দেন, দেখলে মনে হয় আত্মঘাতী হয়েছে ফারদিন। ঘটনার কয়েক দিন পরে ফারদিনের পচাগলা দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘ফারদিনকে একটি কাপড় দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই কাপড়টি সংগ্রহ করে গত ৮ জুন থেকেই নিজের ব্যাগে রেখে দিয়েছিল আঞ্জিব। গোলামকে খুন করা কঠিন, কিন্তু বালক ফারদিন সেই তুলনায় অনেক সহজ নিশানা। এটাই ছিল পরিকল্পনা। এবং ৮ জুন থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন আঞ্জিব। ৯ জুন সেই সুযোগ তিনি পান। ১০ জুন থেকেই খুন ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন ভুয়ো তথ্য ছড়াতে শুরু করেন আঞ্জিব।’’

Advertisement

পুলিশ সুপারের দাবি, খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে আঞ্জিব ব্যবহার করেছিলেন তাঁর পেশাকে। মসজিদে আজান দেওয়ার কাজ করতেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গত ১০ জুন, সোমবার আঞ্জিব নমাজ শেষে এলাকাবাসীকে সাবধান করে দেন যে, এলাকায় ছেলেধরা ঘুরছে। তাই বাইরের লোক দেখলেই মেরে তাড়িয়ে দিতে হবে। ফারদিনকে খুন করে তার পেট থেকে কিডনি এবং চোখ বার করে নিয়েছে দুই মহিলা। যে দুই মহিলা কাজিপাড়ায় এসেছেন মাত্র কয়েক দিন হল। ফলে, পাড়াপ্রতিবেশীর সঙ্গে তাঁদের খুব ভাল আলাপও জমে ওঠেনি। সেই সুযোগ কাজে লাগায় আঞ্জিব। কিন্তু পুলিশি তদন্তে আঞ্জিবের সমস্ত জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল। পুলিশ প্রথম থেকেই আঞ্জিবকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল। পুলিশের সন্দেহ বৃদ্ধি পায়, আঞ্জিবের বার বার বয়ান বদলে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে গ্রেফতার করে ম্যারাথন জেরার মুখে ফেলে পুলিশ। সেখানেই ভেঙে পড়ে দোষ কবুল করেন আঞ্জিব।

পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, আঞ্জিব নিজের দোষ ঢাকতে ছেলেধরার গুজব ছড়িয়েছিলেন। প্রতীক্ষা বলছেন, ‘‘প্রথম গুজব ছড়ানো শুরু করেন কাজিপাড়ার আঞ্জিব।’’ ঘটনাচক্রে, নিজেকে বাঁচাতে আঞ্জিবের ছড়ানো গুজবের জল গড়িয়ে গিয়েছে বহুদূর। বারাসতে একাধিক গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। তার পর তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে অশোকনগর, খড়দহ, বনগাঁ, গাইঘাটাতেও।

এ দিকে, সামান্য তাল নিয়ে বিবাদে নিজের ভাইপোকে খুন করেছেন অঞ্জিব নবি তা কল্পনাও করতে পারছেন না বালক ফারদিনের বাবা, মা। সেই কারণেই বারাসত থানার পুলিশ রবিবার আঞ্জিবকে ফের এক বার জিজ্ঞাসাবাদ করে ফারদিনের বাবা, মায়ের সামনে। সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন ফারদিনের বাবা, মা। বেরিয়ে এসে ফারদিনের বাবা গোলাম কেবল বলেন, ‘‘ভাইয়ের যেন ফাঁসি হয়!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement