গতিহারা: বিদ্যাধরী খাল চড়া পড়ে এই অবস্থায় ও কল্যাণী স্পিনিং মিল। ছবি দু’টি তুলেছেন সুজিত দুয়ারি।
দিন কয়েক আগের ঘটনা। এক হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির সামনে দুষ্কৃতীরা তাঁর মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে টাকা-গয়না লুট করে পালায়। অশোকনগর বিধানসভা এলাকায় এমন ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয় মোটেই। গত পাঁচ বছরে অশোকনগর বিধানসভা এলাকায় বসবাসকারী মানুষের কাছে সব থেকে বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এই সময়ের মধ্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, কেপমারি, তোলাবাজি, বোমাবাজি, খুনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভা এলাকায় ধারাবাহিক চুরির ঘটনা ঘটেছে। মানুষ ভয়ে বাড়ি ফাঁকা রেখে বেরোতে পারতেন না।
বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছর ধরেই দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য চলছে। মদ, জুয়া-সাট্টার কারবার চলে। বহিরাগতদের আনাগোনা বেড়েছে। রাজনৈতিক মদতে বেআইনি মদের কারবার চলছে বলে অভিযোগ। বয়স্করা একা ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিসে টাকা তুলতে যেতে সাহস পান না।
সামনেই বিধানসভা ভোট। কেমন কাটল পাঁচ বছর? মানুষের প্রত্যশা পূরণই বা কতটা হল? বিধায়ক তাঁর প্রতিশ্রুতি পালনে কতটা সফল বা ব্যর্থ হলেন— উঠছে এই সব প্রশ্ন। মানুষজনের আলোচনায় আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথাই বার বার উঠে আসছে। অতীতে এখানে বেশ কিছু কলকারখানা ছিল। অনেক মানুষ কাজ করতেন। সে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নতুন শিল্প তৈরি হয়নি। মানুষের ক্ষোভ রয়েছে নিকাশি ব্যবস্থা নিয়েও।
প্রতি বছর ভারী বৃষ্টিতে অশোকনগর পুরসভা ও গ্রামীণ এলাকার কয়েকটি জায়গায় জল জমে যায়। বেহাল নিকাশির কারণে জমা জল সরতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। জলবন্দি হয়ে ভেলায় যাতায়াত করতে হয়। জল নিকাশির অন্যতম প্রধান মাধ্যম বিদ্যাধরী খাল সংস্কারের অভাবে নালায় পরিণত হয়েছে। সিপিএমের অভিযোগ, কর্মসংস্থানের কোনও সুযোগ গত পাঁচ বছরে হয়নি। নৈহাটি থেকে গঙ্গার জল এনে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্প শেষ হয়নি।
সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক সত্যসেবী কর বলেন, ‘‘গঙ্গার জল আনার পাইপ ২০১৪ সাল থেকে রাস্তায় পড়ে আছে। কল্যাণী স্পিনিং মিলটি টেক্সটাইল হাব বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেটাও হয়নি। নিকাশি বেহাল। রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযুক্ত। আইনশৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি হয়েছে গত পাঁচ বছরে।’’
বিজেপির অভিযোগ, তৃণমূল নেতাদের কাছে চাকরির আশায় অনেকেই টাকা দিয়ে চাকরি পাননি। টাকাও ফেরত পাননি তাঁরা। বিজেপির অশোকনগর বিধানসভা কেন্দ্রের আহ্বায়ক স্বপন দে বলেন, ‘‘অশোকনগর স্টেট জেনারেল হাসপাতাল এখন কোভিড হাসপাতাল হয়েছে। তার আগে এখানে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয়নি। শয্যা বাড়ানো হয়নি। পুরসভা পরিচালিত মাতৃসদন হাসপাতালে ৪ বছর বন্ধ ছিল। সম্প্রতি খোলা হয়েছে। সেখানে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা মেলে না। আমপান ও করোনা পরিস্থিতিতে বিধায়কের ভূমিকা ছিল শূন্য।’’
কী বলছেন তৃণমূল বিধায়ক ধীমান রায়?
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘কল্যাণী স্পিনিং মিলে টেক্সটাইল হাব তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। লকডাউনের জন্য কাজ বন্ধ ছিল। রাস্তা তৈরি ও সংস্কারের জন্য উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতর থেকে ৮ কোটি টাকা এনেছি। রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। থানার পরিকাঠামো বাড়ানো হয়েছে। কর্মী সংখ্যা বেড়েছে। পুলিশি নজরদারি বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। হাবড়া শ্মশান বিদ্যুদয়ন করা হচ্ছে। এর ফলে অশোকনগরের মানুষ উপকৃত হবেন। বিদ্যাধরী খাল সংস্কার করতে পদক্ষেপ করা হয়েছে।’’
গত লোকসভা ভোটে বারাসত কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী কাকলি ঘোষদস্তিদার অশোকনগর বিধানসভা এলাকা থেকে লিড পেলেও ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলেছে বিজেপি। তৃণমূল পেয়েছিল ৪৬.৩ শতাংশ ভোট। বিজেপি পায় ৩৯.৬৪ শতাংশ ভোট। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল প্রার্থী এগিয়ে ছিলেন মাত্র ৬টি ওয়ার্ডে। বাকিগুলিতে এগিয়ে ছিলেন বিজেপি প্রার্থী।
পুর এলাকায় তৃণমূলের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী?
স্থানীয় রাজনৈতিক মহল মনে করছে, এর পিছনে ছিল শাসক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। স্বজনপোষণ, দুর্নীতি এবং মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ দলের অন্তর্তদন্তেও উঠে আসে। দলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অশোকনগরে এসে দলীয় সভায় নেতাদের নির্দেশ দিতে হয়েছিল এক সঙ্গে কাজ করার।
দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, লড়াই এখানে মূলত পুরপ্রশাসক প্রবোধ সরকারের সঙ্গে প্রাক্তন পুরপ্রধান সমীর দত্তের। সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় কোন্দলের জেরে মারপিটের ঘটনাও ঘটেছে।
অশোকনগরে অতীতে সিপিএম তথা বামেদের দাপট ছিল। ২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালা বদলের পর থেকে এখানে বামেদের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সাংগঠনিক ভাবে সিপিএম দুর্বল হতে থাকে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের এখানে বামেরা পেয়েছিল, ৩৮.২৮ শতাংশ ভোট। গত লোকসভায় তা নেমে দাঁড়ায় ৯.৬৫ শতাংশ ভোটে। লোকসভা ভোটে অশোকনগর বিধানসভা এলাকায় বামেদের সরিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে
এসেছে বিজেপি।
তবে আমপান ও করোনা পরিস্থিতিতে বামেরা জনসংযোগ অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছে বলে দলের দাবি। দীর্ঘ দিন ধরে গরিব মানুষদের রান্না করা খাবার তুলে দেওয়া হয়েছে। বিনামূল্যে আউটডোর চিকিৎসা পরিষেবা চালু করা হয়েছে। জলমগ্ন এলাকায় ওষুধ, খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন বাম কর্মী-সমর্থকেরা। ইদানীং সিপিএমের মিটিং-মিছিলে ভিড় বাড়ছে। তরুণ প্রজন্মকেও আসতে দেখা যাচ্ছে। অতীতে সিপিএম নেতৃত্ব গোষ্ঠী কোন্দলে বিভক্ত ছিলেন। এখন অবশ্য নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্যই দেখা যায়। কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ কর্মসূচিতেও সাড়া মিলছে।
অশোকনগরে বহু বছর ধরেই বিজেপির কিছু শক্তি ছিল। ১৯৯৯ সালে বিধানসভার উপনির্বচনে অশোকনগর থেকে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী বাদল ভট্টাচার্য। তখন অবশ্য তিনি তৃণমূলের সঙ্গে জোট প্রার্থী ছিলেন। বাদলই রাজ্যের বিজেপির প্রথম বিধায়ক ছিলেন। গত লোকসভা ভোটে বিজেপি ভাল ফল করেছে এই এলাকায়। সাংগঠনিক ভাবে তাদের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে বলে দাবি বিজেপি নেতৃত্বের। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ৮.৩৭ শতাংশ ভোট। লোকসভায় তা এক লাফে বেড়েছে ৩৯.৬৪ শতাংশ।
অশোকনগরে ওএনজিসি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। ভোটের আগে এটাকে কেন্দ্রের সাফল্য বলে তুলে ধরতে চাইছে বিজেপি। তবে বিজেপির কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের আদি ও নব্য গোষ্ঠীর বিবাদ।