জুতো সেলাই করছেন সুভাষ। —নিজস্ব চিত্র।
কথা বলতে বলতে মুখ লুকিয়ে চোখের জল মুছছিলেন হিঙ্গলগঞ্জের সুভাষচন্দ্র দাস। বলছিলেন, ‘‘আমার আর স্কুলের চাকরি হল না!’’
শিক্ষক দিবসের দিন সকালে চুয়াল্লিশ পেরোনো সুভাষের জুতো সেলাই করেন এখন।
সাগরের লক্ষ্মণ মণ্ডল অবশ্য হাল ছাড়েননি। জানালেন, বত্রিশ বছর বয়সেও হাল ছাড়িনি, চাকরির পরীক্ষায় বসার জন্য যে বয়স নির্ধারিত আছে, তত দিন পরীক্ষা দেব।’’ আপাতত সংসার সামলাতে পানের বরজে কাজ করেন লক্ষ্মণ।
জেলা জুড়ে মঙ্গলবার শিক্ষক দিবসের সকালে যখন নানা আয়োজন, তখন তারই নীচে চাপা পড়ে আছে সুভাষ, লক্ষ্মণদের মতো অনেকের হতাশা। হিঙ্গলগঞ্জের দক্ষিণ গোবিন্দকাটি গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ ইতিহাস নিয়ে এমএ, বিএড করেছেন। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নপূরণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। ইন্টারভিউয়ে ডাক পান। প্যানেলে নাম ওঠে। তবে নিয়োগ হয়নি। অপেক্ষা করে করে এখন সুভাষের বয়স পেরিয়ে গিয়েছে।
জুতো সেলাইয়ের পাশাপাশি সুভাষ গৃহশিক্ষকতা করেন। ২০-২৫ জন পড়ুয়া আসে। তাতে পেট চলে না। ফলে যোগেশগঞ্জ বাজারে বসেন জুতো সেলাই করতে। সব মিলিয়ে আয় মাসে হাজার চারেক। সুভাষ বলেন, ‘‘শিক্ষক দিবসে মনে পড়ে যায়, যখন যোগেশগঞ্জ হাইস্কুলে পড়তাম, দিনটা শিক্ষকদের সঙ্গে খুব সুন্দর কাটত। স্বপ্ন দেখতাম, এক দিন আমিও শিক্ষক হব। এখন নিজের স্কুলের সামনের বাজারে জুতো সেলাই করতে হচ্ছে।’’
সুভাষ বিয়ে করেছিলেন এমএ শেষ করেই। শিক্ষকের চাকরি পাবেন তখনও আশা ছিল। তবে স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলেন, শিক্ষকের চাকরি হলে আবার সংসার পাতবেন। তেমন কিছু ঘটেনি। এখন ভাইয়ের সংসারে থাকেন সুভাষ। বললেন, ‘‘বয়স যা হয়েছে, তাতে আর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নপূরণ হবে না। যে ক’জন বাচ্চাকে বাড়িতে পড়াই, তারা আমাকে শুভেচ্ছা জানাল আজকের দিনে— ওটুকুই সান্ত্বনা।’’
এমএ, বিএড করেছেন সাগরের খান সাহেব আবাদ গ্রামের বাসিন্দা লক্ষ্মণ। তাঁর বিষয় বাংলা। ২০১৪ সালে উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন লক্ষ্মণ। ইন্টারভিউতেও ডাক পান। লক্ষ্মণ বলেন, ‘‘ইন্টারভিউয়ের ফলাফল আজও বেরোয়নি। তাই নিয়োগও বন্ধ।’’
এখন লক্ষ্মণ ছোট একটি কোচিং সেন্টারে সপ্তাহে দু’দিন ৩০ জন পড়ুয়াকে পড়াতে যান। তবে তাতে সংসার চলে না। সপ্তাহের বাকি দিনগুলিতে অন্যের বাড়িতে পান গোছানোর কাজ করতে যান। যে হাতে চক-ডাস্টার ধরে ক্লাসে পড়ানোর স্বপ্ন ছিল, সেই হাতে পানপাতার বোঁটা, মাথা সাজাতে হয়। পান গুছিয়ে হাজার পাঁচেক আসে, টিউশনে তিন হাজার। এতেই সংসার চলে।
শিক্ষক দিবসের দিনে বাড়ির পাশে ফাঁকা এক জায়াগায় বসে ভারাক্রান্ত মনে লক্ষ্মণ বলেন, ‘‘‘পরীক্ষায় পাশ করেও চাকরি মেলেনি। তাই বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় আসতে হয়েছে।’’ তাঁর মনে পড়ে, ‘‘স্কুল জীবনে শিক্ষক দিবসের আনন্দটা খুব ভাল ছিল। ওই দিন স্কুলের সিনিয়র ছাত্রেরা ছোটদের ক্লাস নিত। আমিও নিয়েছিলাম। এখন কোচিং সেন্টারের ছেলেমেয়ের শুভেচ্ছা বুকে নিয়েই স্বপ্ন দেখি। কারণ, শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হবে কি না জানি না।’’