স্মৃতি: মেয়ের ছবি হাতে দম্পতি ছবি: সুজিত দুয়ারি
বৃদ্ধ দম্পতির দানের জমিতে তৈরি হল স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এলাকার বাসিন্দাদের কাছে সহজে উন্নতমানের চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে অশোকনগরের কল্যাণগড় এলাকার বাসিন্দা ওই দম্পতি নিজেদের বাড়ি, জমি দান করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চকে। বিজ্ঞান মঞ্চ সেই জমিতেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি তৈরি করেছে। ২০১৯ সালে দম্পতির একমাত্র মেয়ে পূরবীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। মেয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে দম্পতির ওই পদক্ষেপ। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পূরবী স্বাস্থ্যকেন্দ্র।’ শনিবার ছিল পূরবীর জন্মদিন। ওই দিনই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির উদ্বোধন করা হয়।
কল্যাণগড় এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী দীপঙ্কর রাহা। বয়স চুয়াত্তর। স্ত্রী লক্ষ্মী রাহা অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। তিনি অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভায় দু’বারের সিপিএম কাউন্সিলর। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৫ সালে পূরবীর বিয়ে হয়েছিল। ২০১৭ সালে তাঁর স্বামী মারা যান। বাপের বাড়ি ফিরে আসেন পূরবী। মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তারপর থেকেই। ২০১৯ সালে বাড়িতেই অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়।
দীপঙ্কর ও লক্ষ্মীর বাড়ি-সহ পাঁচ কাঠা জমি রয়েছে। দীপঙ্কর দীর্ঘ দিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা বাড়ি, জমি বিজ্ঞান মঞ্চকে দান করেছেন। এখন একটি দোতলা বাড়িতে থাকেন। মৃত্যুর পরে এই বাড়িটিও বিজ্ঞান মঞ্চ পাবে বলে জানায় পরিবার। স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করেছে বিজ্ঞান মঞ্চ। ভবন তৈরির খরচ বিজ্ঞান মঞ্চই ব্যয় করেছে। দম্পতিও আর্থিক সাহায্য করেছেন। পুরপ্রশাসক প্রবোধ সরকার বলেন, ‘‘ওই দম্পতি প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। এর ফলে মানুষের চিকিৎসার সুযোগ আরও বাড়ল।’’ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার বিনামূল্যে থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয় পরীক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সূচনা হয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ৫২ জন মেয়ে এ দিন পরীক্ষা করিয়েছে। এ ছাড়া, স্কুল ছাত্রী এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের এ দিন ভেষজ আবির তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর করাই লক্ষ্য।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান মঞ্চের রাজ্য নেতা সৌরভ চক্রবর্তী। মঞ্চের অশোকনগর কেন্দ্রের সম্পাদক প্রদ্যুৎ কর্মকার, অশোকনগরের প্রাক্তন বিধায়ক সত্যসেবী কর-সহ বিশিষ্ট চিকিৎসকেরাও ছিলেন।
বিজ্ঞান মঞ্চ সূত্রে জানা গিয়েছে, দীপঙ্করের মা প্রয়াত কল্যাণীই ছিলেন অশোকনগরের প্রথম মানুষ, যিনি মরণোত্তর চোখ ও দেহ দান করেছিলেন। দীপঙ্করদেরর অনেক দিন আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল মায়ের নামে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করার। তখন পূরবী বেঁচে। তিনিও বাবা-মায়ের ইচ্ছায় সহমত জানিয়েছিলেন।
সূচনা হলেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি সম্পূর্ণ ভাবে চালু করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে জানানো হয়েছে। প্রদ্যুৎ বলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য, ১ জুলাই থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি সম্পূর্ণ ভাবে চালু করা। ইতিমধ্যেই পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়ে গিয়েছে। তাঁরা বিনামূল্যে রোগী দেখবেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে এবং চিকিৎসকদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য রোগীদের কাছ থেকে ন্যূনতম কিছু টাকা নেওয়া হতে পারে। রাতে অক্সিজেন নেবুলাইজ়ারের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া, নিয়মিত রক্তচাপ মাপা, সুগার পরীক্ষা করা হবে। রোগীদের বসার জন্য আরও একটি ঘর তৈরি করা হচ্ছে।’’
দম্পতির আরও একটি স্বপ্ন, কল্যাণীর নামে একটি বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করা। তাঁদের কথায়, ‘‘মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি। এলাকার মানুষ যাতে বাড়ির কাছে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা পান, বিনা চিকিৎসায় কেউ যাতে মারা না যান, সে কারণেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি তৈরি করা। এখানে বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে নিয়মিত আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে।’’