ভোটে না দাঁড়ালে ওঁরা অনেকে জানতেই পারতেন না, এত মানুষ এত সমস্যার মধ্যে আছেন। ভোটে না দাঁড়ালে ওঁরা এটাও জানতে পারতেন না, জনপ্রতিনিধিদের উপরে কতটা ভরসা রাখেন সাধারণ মানুষ।
বনগাঁ পুরসভায় এ বার ওঁরা সকলেই প্রথম বার ভোটে দাঁড়িয়েছেন। তবে সরাসরি রাজনীতির অভিজ্ঞতা বলতে অনেকেরই তেমন কিছু ছিল না। কেউ স্বামীর কথায়, কেউ শ্বশুরের অনুরোধে দাঁড়িয়েছেন। বাকিদের কারও কারও রাজনীতির পুরনো অভিজ্ঞতা এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে।
বনগাঁ পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এ বার শ্বশুরের ইচ্ছায় তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন বছর সাতাশের সোমাঞ্জনা মুখোপাধ্যায় মুন্সি। নিজে নাচ শেখান। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা বিভাগে পার্ট টাইম শিক্ষকতা করেন সোমাঞ্জনা। এলাকাতেই নিজের নাচের স্কুল। হঠাৎই রাজনীতির আঙিনায় পা রেখেছেন। তবে বাপের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়িতে রাজনীতির পরিবেশ দেখেছেন বরাবর। বাংলায় এমএ সোমাঞ্জনার বড় জ্যাঠামশাই পঙ্কজ মুন্সি বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। সোমাঞ্জনার শ্বশুর তাপস মুখোপাধ্যায় (কটা) বনগাঁ পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর। ওয়ার্ডটি এ বার মহিলা-সংরক্ষিত হয়েছে।
কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় বৌমাকে দাঁড়াতে হয়েছে। সোমাঞ্জনা বলেন, ‘‘বাপের বাড়িতে রাজনীতির পরিবেশ থাকলেও প্রত্যক্ষ ভাবে বিষয়টি শ্বশুর বাড়িতে এসেই দেখেছি। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের আমার কখনও খারাপ মনে হয়নি। আর আমাকে তো অবস্থার প্রেক্ষিতে দাঁড়াতে হয়েছে।’’
ওই ওয়ার্ডটি নিজের হাতের তালুর মতো চেনেন কটাবাবু। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ওয়ার্ড কাউন্সিলর। অতীতে কংগ্রেসের হয়ে জিতেছেন। কিছু দিন আগে তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। বৌমাকে জিতিয়ে আনাটা তাঁর কাছেও বড় চ্যালেঞ্জ।
বছর তেইশের গৃহবধূ প্রিয়াঙ্কা সাহা মণ্ডল এ বার বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে। বাপের বাড়ি বা শ্বশুর বাড়ি কোথাও কোনও রাজনীতির পরিবেশ নেই। প্রিয়াঙ্কার ভোটে দাঁড়ানোর একটা ইচ্ছে ছিলই। হঠাৎ করেই দলের নেতারা তাঁর স্বামী বিশ্বজিৎকে জানায়, প্রিয়াঙ্কাকে ভোটে দাঁড় করাতে চান। বিশ্বজিৎবাবু স্ত্রীকে ওই কথা জানাতেই প্রিয়াঙ্কা রাজি হয়ে যান। তাঁর কথায়, ‘‘আমার নিজেরও ইচ্ছা ছিল। স্বামী বলতেই রাজি হতে আর সময় নিইনি।’’ কেন ভোটে দাঁড়ালেন? প্রার্থীর কথায়, ‘‘এলাকায় নিকাশি, রাস্তা-সহ নানা সমস্যা রয়েছে। এলাকার মানুষের সমস্যার সুরাহা করতে আমি ভোটে দাঁড়িয়েছি।’’ তিনি মনে করেন, সুযোগ এলে ঘরের বৌদেরও এক বার ভোটে দাঁড়ানো উচিত। রাজনীতি করাও উচিত। মহিলারা এগিয়ে এলে সমাজের নানা কাজ অন্য মাত্রা পাবে।
বনগাঁ শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জীবনে এ বারই প্রথম ভোটে দাঁড়িয়েছেন বনগাঁ চেম্বার্স অফ কর্মাসের সহ সম্পাদক স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলীপ মজুমদার। তিনি ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দা নন। তবে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ায় দিলীপবাবু পুর এলাকায় কমবেশি পরিচিত মুখ। দীর্ঘদিন ডানপন্থী রাজনীতির সঙ্গে রয়েছেন। কিন্তু ভোটে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন এ বারই প্রথম। তা-ও আবার শাসক দলের টিকিটে। তাঁর কথায়, ‘‘এমন অনেক বাড়িতে যাচ্ছি, যেখানে বাড়ির লোকজন প্রার্থীকে দেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। রাজনীতিবিদদের সর্ম্পকে তাঁরা বীতশ্রদ্ধ। ওয়ার্ডটি পুরসভার মধ্যে হলেও উন্নয়ন বলতে কিছুই হয়নি এখানে।’’ প্রার্থী জানালেন, ওয়ার্ডের বহু মানুষ এখনও পাতা কুড়িয়ে রান্না করে খান। অনেক পরিবারে শৌচাগার নেই। কিছু পরিবার ত্রিপলের নীচে থাকেন। বর্ষায় এলাকার বিভিন্ন এলাকা ডুবে যায়। প্রার্থী বলছেন, ‘‘ওই সব হতদরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। ভোটে হারি বা জিতি ওঁদের সাহায্য করবই। ভোটে না দাঁড়ালে বুঝতেই পারতাম না, পুর এলাকার মানুষও এত কষ্টে বাস করছেন।’’
১৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এ বারে নির্দল প্রার্থী হিসাবে প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন বনগাঁর প্রাক্তন পুরপ্রধান পরিতোষ নাথের ছেলে মনোতোষ ওরফে লাল্টু। পেশায় স্কুল শিক্ষক লাল্টুর রক্তে রয়েছে রাজনীতি। কেন ভোটে দাঁড়ালেন বছর আটচল্লিশের লাল্টু। তাঁর কথায়, ‘‘স্বচ্ছ নাগরিক পরিষেবা দিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ প্রচারে বেরিয়ে তাঁর মনে হয়েছে, ‘‘রাজনীতিতে এখনও শিক্ষিত মানুষের এগিয়ে আসা উচিত। তা হলে দুর্নীতি কম হবে। ’’
১০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্দল প্রার্থী হিসাবে এ বারই প্রথম ভোটে দাঁড়িয়েছেন বছর আটচল্লিশের চঞ্চল বিশ্বাস। বনগাঁ আদালতে তাঁর ফটোকপির দোকান রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। বললেন, ‘‘দীর্ঘদিন সামাজিক কাজে যুক্ত রয়েছি। সেই কাজ আরও বেশি করে করতেই ভোটে দাঁড়িয়েছি।’’ নির্দল প্রার্থী হলেও বামেরা তাঁকে সমর্থন করেছেন।
১৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সিপিএম প্রার্থী হয়েছেন ৫৪ বছরের মায়া ঘোষ। তিনি গৃহবধূ। লেখাপড়া উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বহু দিন। ভোটে দাঁড়ানোর স্বপ্নও দীর্ঘদিনের। দল থেকে প্রস্তাব দিতেই তিনি রাজি হয়ে যান। কেন ভোটে দাঁড়ালেন? মায়াদেবী বললেন, ‘‘দুনীর্তি মুক্ত পুরবোর্ড গঠনে সাহায্য করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ তিনি মনে করেন, মহিলাদের আরও বেশি করে ভোটে দাঁড়ানো উচিত। তা হলে দুর্নীতি কমবে।
এ বার বনগাঁ পুরসভা ভোটে ডান-বাম দুই পক্ষেরই বেশ কয়েক জন তরুণ-তরুণী প্রার্থী হয়েছেন। তৃণমূল ১৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রার্থী করেছে ছাত্র সংগঠনের নেত্রী মৌসুমী চক্রবর্তীকে। বছর চব্বিশের মৌসুমী এ বারই প্রথম ভোটে দাঁড়িয়েছেন। সিপিএম থেকে ২১ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন বছর পঁচিশের প্রসেনজিৎ ভৌমিক। বিএ পাশ বেকার যুবককে ঘিরে এলাকার মানুষ কৌতুহলী। বিজেপির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী রথীন্দ্রনাথ হালদার। রাজনীতির ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কংগ্রেস প্রার্থী করেছে তরুণী গৃহবধূ সোমা রায়কে।