উৎসাহ: ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে সভায় ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দান। —নিজস্ব চিত্র
ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়তেই হাসি মুখে স্কুলে ঢুকে পড়ে পড়ুয়ারা। প্রার্থনা শেষের পর ক্লাসে নয়, মাঠের দিকে ছুটে যায় তারা। সেখানেই শুরু হল ব্রতচারী। এরপরে নাচ, গান, ছড়ার মাধ্যমে চলল ইতিহাস, ভূগোলের পাঠ। গানের সুরে সুরে নামতাও আউড়ে নিল খুদেরা।
এমন দৃশ্য চোখে পড়ছে ফলতার বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে। সম্প্রতি স্কুল ছুট বন্ধ করে খুদে পড়ুয়াদের ক্লাসে ফেরাতে ফলতা ব্লক প্রশাসন, পঞ্চায়েত সমিতি ও স্কুল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে শুরু হয়েছে ‘চল স্কুলে যাই’ প্রকল্প। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, এর মাধ্যমে ভাল সাড়া পাওয়া গিয়েছে। প্রায় সমস্ত প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করা গিয়েছে।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত দু’বছর করোনা ও লকডাউনের জেরে স্কুল দীর্ঘ সময় অনিমিত ছিল। অনেক অভিভাবকেরা কাজ হারিয়ে আর্থিক অনটনের শিকার হয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে পড়ুয়াদের মধ্যেও। ছোটরা অনেকে পড়াশোনার প্রতি উৎসাহ হারিয়েছে। বেড়েছে স্কুলছুটের সংখ্যা।
এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সম্প্রতি পদক্ষেপ করে ফলতা ব্লক প্রশাসন। ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগে সমস্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও এলাকার পঞ্চায়েতের সদস্যেরা মিলে গ্রামে গ্রামে ঘুরবেন। প্রতিটি শিশু স্কুলে যাচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনও পরিবারে বিশেষ কোনও সমস্যা থাকলে তার সমাধান করে ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রাথমিক ভাবে পাঁচ থেকে দশ বছর বয়সি পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করতে জোর দেওয়া হয়। স্কুলে আনার পরেও পড়ুয়াদের ধরে রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে পুষ্টিকর মিড-ডে মিলে। ছোটদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে শাসনের বদলে ভালবাসা দিয়ে শিশুর মন বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। বদল আনা হয়েছে গতানুগতিক পড়াশোনার পদ্ধতিতেও। ছোটদের ছড়া বলে ব্রতচারী নাচের মাধ্যমে, গল্পের ছলে পড়ার প্রতি মনোযোগী করে তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন থাকছে নাচ, যোগাসন ও খেলাধুলোর ব্যবস্থা।
এই পদ্ধতি মেনে ইতিমধ্যে সাফল্য পেয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুল। এই ব্লকের বইচ বেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোটাল ডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়, নওদা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভগবানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়-সহ বেশ কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁদের স্কুলে পড়ুয়াদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পড়ুয়াদের ভর্তির সংখ্যাও স্বস্তি দিচ্ছে তাঁদের। কোটালডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা তাপসী কয়াল বলেন, ‘‘ব্লক প্রশাসনের নির্দেশ মেনে শিক্ষাবর্ষ শুরুর সময়ে আমরা চারটি গ্রামে যাই। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলি। পাশাপাশি, মিড-ডে মিলের মেনুতে পরিবর্তন করা হয়েছে। রাখা হচ্ছে ডিম, ফল, ফ্রায়েড রাইস, মাংস। এতেই সাফল্য মিলেছে।’’
বইচবেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কিংশুক হালদার বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েদের গান, আবৃত্তি, ব্রতচারী, খেলাধুলোর মাধ্যমে নানা জিনিস শেখানো হচ্ছে। এতে ওদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। পাশাপাশি, অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করে তাঁদের সচেতন করা হচ্ছে।’’
পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ আতিকুল্লা মোল্লা জানান, তিনি নিয়মিত বিভিন্ন স্কুলে ঘুরে কর্তৃপক্ষ ও পড়ুয়াদের কথা শুনছেন। কোনও সমস্যা থাকলে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘আমি চাই প্রতিটা স্কুলে রোজ সমস্ত পড়ুয়া আসুক। বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গির খান ও বিধায়ককে পাশে পেয়েছি। তাঁরা পোশাক, বইপত্র, স্কুলের পরিকাঠামোগত সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ করছেন। এতেই সফল হয়েছে চল স্কুলে যাই প্রকল্প।’’
এ বিষয়ে ফলতা ব্লকের বিডিও সন্দীপ ঘোষ বলেন, ‘‘মাস কয়েক আগে আমি একটি প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে দেখি, উপস্থিতি হাতেগোনা। এরপরে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রকল্প চালু করা হয়। ইতিমধ্যে সাফল্য মিলেছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৭০০ জন স্কুলছুট পড়ুয়াকে ফিরিয়ে আনা গিয়েছে। এ বার এদের ধরে রাখা স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।’’