কেন্দ্রীয় বাহিনীর দখলে সন্দেশখালি। — নিজস্ব চিত্র।
আর পাঁচটা দিনের মতো বৃহস্পতিবারও কাকভোরেই ঘুম ভেঙেছিল সন্দেশখালির। ঈষৎ মেঘলা আকাশে অসময়ের বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল, গুমোটেরও। বেলা গড়াতে গুমোট ভাব তো কমলই না, উল্টে তা বৃদ্ধি পেল কয়েক গুণ। যখন বাস, ট্রাক ভরে ভরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা ঢুকতে লাগলেন নদী, নালা ঘেরা সন্দেশখালিতে। দিনের কাজে বেরিয়ে পড়া প্রত্যন্ত সন্দেশখালি অবাক হয়ে দেখল, এক লহমায় কী করে এলাকার ‘দখল’ কায়েম করে নিল কেন্দ্রীয় বাহিনী! সাম্প্রতিক কালে অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে সন্দেশখালি। দেখেছে ‘বাঘ’কেও কেঁচো হয়ে যেতে! কিন্তু একলপ্তে এত বাহিনী দেখেনি। তাই সাতসকালে রণসাজে সজ্জিত বাহিনীর জওয়ানদের দেখে অবাক সন্দেশখালি। তা হলে কি আবার বড় কোনও ‘অপারেশন’?
আমদানি-রফতানি ব্যবসায় অনিয়মের অভিযোগে একটি ইসিআইআর করেছে ইডি। তার ভিত্তিতেই তদন্ত শুরু হয়েছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এই মামলার তদন্তে হাওড়া, কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা-সহ মোট ছ’জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালায় ইডি। জেলবন্দি শাহজাহান-ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েক জন মাছ ব্যবসায়ীর বাড়িতেও গিয়েছিলেন ইডির তদন্তকারী আধিকারিকরা। তারই তদন্তে বৃহস্পতিবার সাতসকালে সন্দেশখালি পৌঁছে গেল ইডি। সঙ্গে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
সন্দেশখালির রাস্তায় টহল কেন্দ্রীয় বাহিনীর। বৃহস্পতিবার সকালে। — নিজস্ব চিত্র।
গত ৫ জানুয়ারি সন্দেশখালির সরবেড়িয়ায় শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালাতে গিয়েছিল ইডি। সঙ্গে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীও। কিন্তু শাহজাহানের অনুগামীদের মারমুখী মেজাজের মুখে পড়ে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে হয় তাঁদের। তার পর থেকে একাধিক বার কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় সন্দেশখালি ঘুরে গিয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। তবে বৃহস্পতিবার যেন সম্পূর্ণ আলাদা। ইডি সূত্রের খবর, এ দিন সন্দেশখালিতে গিয়েছে সিআরপিএফ, বিএসএফ। সঙ্গে রয়েছে রাজ্য পুলিশ এবং রাজ্য পুলিশের র্যাফ ও ইএফআর। এত বাহিনী একসঙ্গে নিয়ে যেতে বাসের পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে সেনা পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত সামরিক ট্রাক। ছাউনি দেওয়া সেই সমস্ত ট্রাক টিভিতে দেখে অভ্যস্ত সন্দেশখালি। এমন গাড়ি তাঁদের গ্রামে কেন?
স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, সন্দেশখালিতে ঢুকেই এলাকার দখল নিয়ে নেয় বাহিনী। সন্দেশখালি ঢোকা-বেরোনোর সমস্ত পথ আগলে দাঁড়িয়ে যান ক্যামোফ্ল্যাজ উর্দিধারীরা। ভারী বুটের আওয়াজ শোনা যায় নৌকাঘাট থেকে শুরু করে নদীর পার বরাবরও। এলাকার বাজারকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলে কেন্দ্রীয় বাহিনী। মাছের আড়ত, যাত্রী প্রতীক্ষালয় থেকে শুরু করে সাধারণ রাস্তাতেও রণসাজে সজ্জিত বাহিনীর অবাধ ঘোরাফেরা শুরু হয়ে যায়। মুহূর্তে যেন সন্দেশখালি চলে যায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর আওতায়। যে যে বাড়িতে তল্লাশি বা জিজ্ঞাসাবাদ করতে ঢোকেন ইডি আধিকারিকেরা, সেই বাড়িগুলিকে চারপাশ থেকে কার্যত সিল করে দেন জওয়ানেরা। ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছে না কাকপক্ষীকে। সূত্রের খবর, ন’টিরও বেশি ছাউনি দেওয়া সামরিক ট্রাক এবং বাস, গাড়িতে করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দু’শতাধিক জওয়ান সন্দেশখালিতে এসেছেন।
বাইরে থেকে হামলা ঠেকাতে বা বাইরে থেকে অনাহুত কেউ এলাকায় যাতে ঢুকে পড়তে না পারেন, সে জন্য নদীর পার বরাবর সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা। নদীর ঘাটেও কড়া নজর রেখে চলছে টহলদারি। এত বাহিনী একসঙ্গে সন্দেশখালিতে ঢুকে পড়লেও, সাধারণ মানুষের যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সে দিকেও নজর রাখা হচ্ছে। কোনও রাস্তা আটকানো হয়নি। নজরদারির মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করতে বাধা পেতে হচ্ছে না স্থানীয়দের। যদিও একসঙ্গে এত বাহিনী দেখে অবাক বাসিন্দারা।
সাতসকালে নদীর পারে বসে মাছ ধরছিলেন রুনা বিবি শেখ। আচমকাই ভারী বুটের শব্দ পেয়ে পারের দিকে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ! এত পুলিশ কেন? শুরুতে ঘাবড়ে গিয়ে জাল গুটিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন রুনা। কিন্তু বাহিনী তাঁকে অভয় দেয়, নির্ভাবনায় নিজের কাজ করুন। রুনা আবার জাল ছড়িয়ে দেন নদীতে। সেই রুনা বলছেন, ‘‘আমি তো মাছ ধরছিলাম। এত বাহিনী জীবনেও দেখিনি। তাই অবাক তো হবই। একসঙ্গে এত বাহিনী এসেছে, বড় কোনও ব্যাপার আছে মনে হয়। আমাদের কিছু বলেনি। শুধু গার্ড (পাহারা) দিচ্ছে।’’
নদীর পার থেকে একটু এগিয়েই দেখা মনোরঞ্জন সর্দারের সঙ্গে। স্থানীয় বাসিন্দা মনোরঞ্জনের অভিযোগ, তাঁর এক বিঘা জমি রয়েছে। কিন্তু শাহজাহানের ভাই সিরাজ ডাক্তার (সিরাজউদ্দিন শেখ) তাঁকে ৫ কাঠার বেশি জমিতে কাজই করতে দেননি। কিন্তু এত বাহিনী দেখে তিনিও অবাক! মনোরঞ্জন বলছেন, ‘‘অবাক লাগছে, এত বাহিনী কেন? আমাদের উপর খুব অত্যাচার হয়েছে। মনে হচ্ছে, আমাদের এখানে এত বাহিনী এসেছে যখন, তখন আমাদের ভালর জন্যই এসেছে। আমার নিজের এক বিঘা জমি আছে। কিন্তু সিরাজ ডাক্তার মাত্র পাঁচ কাঠা জমিতে কাজ করতে দেয়।’’ মনোরঞ্জন মনে করছেন, তাঁরা এত দিন ধরে যে অত্যাচার সয়েছেন তারই প্রতিকার করতে গ্রামে কেন্দ্রীয় বাহিনী ঢুকেছে।