অসুস্থ: সিলিকোসিসে আক্রান্ত মিনাখাঁর গোয়ালদহ গ্রামের দুই যুবক। নিজস্ব চিত্র
২০১৯ সালের জুন মাসে মিনাখাঁর গোয়ালদহ গ্রামে সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান হাসানুর মোল্লা। সংসারের হাল ধরতে তাঁর স্ত্রী হাসিনা জরির কাজ করেন। এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে বাবুসোনা মোল্লা শ্বাসকষ্টজনিত কারণে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পেরেছে। স্বামীই সংসারের একমাত্র রোজগেরে ছিলেন। তাঁর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সামান্য সঞ্চয়টুকুও শেষ হয়ে যায়। স্বামী মারা যাওয়ার পর এখনও সরকারি ক্ষতিপূরণ মেলেনি। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনও রকমে দিন কাটছে হাসিনার।
এর মধ্যে আরও বিপত্তি। ছেলেরও সিলিকোসিস ধরা পড়েছে। হাসিনার কথায়, ‘‘স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন কী ভাবে ছেলের চিকিৎসা করাব, বুঝতে পারছি না। সরকারি ক্ষতিপূরণ বা সাহায্য পাইনি।’’
শুধু হাসিনা নন, ওই গ্রামে সিলিকোসিসে আক্রান্ত ও মৃতদের পরিবারগুলির কার্যত এমনই অবস্থা। অনেককেই চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমি-বাড়ি বন্ধক রেখেছেন। সে সব ছাড়াতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রাত কাটে।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, হরিয়ানা মডেলে সিলিকোসিসে মৃতের পরিবারগুলিকে এককালীন ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আক্রান্ত ও মৃতের পরিবারগুলিকে পেনশনের ব্যবস্থা এবং তাদের সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। সেই সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
অথচ হাইকোর্টের নির্দেশের পরেও এখনও তা কার্যকর হয়নি বলে অভিযোগ। এ দিকে সিলিকোসিসের মতো মারণ রোগে আক্রান্ত হয়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এর আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও সিলিকোসিসে আক্রান্ত ও মৃতদের পরিবারগুলিকে এককালীন ৪ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মিনাখাঁ ব্লকের গোয়ালদহ গ্রামের সিলিকোসিসে আক্রান্ত মৃত ২৩ জনের পরিবারের মধ্যে মাত্র ন’টি পরিবার চার লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ পরিবার এখনও সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা বা অন্যান্য প্রতিশ্রুতি মতো সুযোগ-সুবিধা পায়নি বলে অভিযোগ।
সিলিকোসিসে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন আইনজীবী সামিম আহমেদ। তিনি বলেন, ‘‘অসহায় মানুষগুলির কথা ভেবে এবং তাদের পাশে দাঁড়াতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলাম। মহামান্য আদালত রাজ্য সরকারকে হরিয়ানা মডেলে সিলিকোসিস আক্রান্ত ও মৃতদের পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তারপরেও রাজ্য কোনও উদ্যোগ করেনি। আমরা পুরো বিষয়টি আদালতকে জানাব।’’
ইতিমধ্যে স্থানীয় কিছু যুবক আক্রান্ত ও মৃতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গড়ে তুলেছেন ‘সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি।’ সংগঠনের সভাপতি সাইদুল পাইক বলেন, ‘‘আমরা অসহায় পরিবারগুলির পাশে দাঁড়াতে এই সংগঠন তৈরি করেছি। তাঁরা যাতে সব রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান, সে জন্য প্রয়োজনে বৃহত্তর আন্দোলনে যাব।’’
নির্দেশ কার্যকর করতে কলকাতা হাইকোর্ট একটি কমিটিও গঠন করে দিয়েছিল। ওই কমিটির মাথায় রাখা হয় স্টেট লিগাল সার্ভিস অথরিটির চেয়ারম্যানকে। এ ছাড়া এই কমিটিতে আছেন স্বাস্থ্য, শ্রম দফতরের কর্তা, জেলাশাসক, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আধিকারিকেরা।
অকুপেশনাল সেফটি এন্ড হেল্থ অ্যাসোসিয়েশন অফ ঝাড়খণ্ডের সাধারণ সম্পাদক সুমিত কুমার কর বলেন, সিলিকোসিস চিহ্নিতকরণ এবং নির্মূল করণের লক্ষ্যে কাজ করে।সরকার যে নিউমোকনিওসিস বোর্ড গঠন করেছে তা সক্রিয় করতে হবে।যার মাধ্যমে আক্রান্তদের চিহ্নিতকরণ করে তাদের পুনর্বাসন ও তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।মিনাখাঁ ব্লক হাসপাতালকে আরও উন্নতিকরণ করতে হবে।
এ রাজ্যে সিলিকোসিস আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করেন অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অফ ঝাড়খণ্ডের সাধারণ সম্পাদক সুমিতকুমার কর। তিনি জানান, সিলিকোসিস চিহ্নিতকরণ এবং নির্মূল করার লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একটি বোর্ড গঠন করেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট
সক্রিয় নয়। উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক চৈতালি চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘আমরা সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্বাস্থ্য শিবির করেছি। যাতে পরিবারগুলি অন্য সুবিধা পায়, তার ব্যবস্থা করেছি।’’ সরকারি ক্ষতিপূরণের বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।