গ্রামটাই উধাও, উত্তম শহর এখন মধ্যমগ্রামে।
ঝাঁ-চকচকে রাস্তা, সুইমিং পুল, চিলড্রেন্স পার্ক, কলের জল। এ বার ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে সিসিটিভি লাগাবার প্রস্তুতি চলছে। পাশেই বারাসত পুরসভা যদি অফিসপাড়ার শহর হয়, নিউ ব্যারাকপুর যদি পাড়া সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হয়, মধ্যমগ্রাম তবে সল্টলেক বা রাজারহাটের ধাঁচে আবাসন-শহর— গোছানো ফ্ল্যাট, সঙ্গে আধুনিক পরিষেবাও।
হবে না-ই বা কেন? পুরসভার ১ লক্ষ ৯৭ হাজার বাসিন্দার মধ্যে ৮৪ শতাংশই সাক্ষর। ফলে এই পুরসভার ভোটে উন্নয়নই একমাত্র ইস্যু হয়নি কোনও দিনই। এলাকায় ব্যাপক উন্নতি করা সত্ত্বেও অতীতে পুরভোটে হেরেছে বামেরা। একই হাল হয়েছে তৃণমূলেরও। পুরসভা গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত কোনও দলই পরপর দু’বার বোর্ড দখলে রাখতে পারেনি। বিদায়ী বোর্ড তৃণমূলের। মধ্যমগ্রামের ট্র্যাডিশন বজায় থাকলে এ বার ফের ক্ষমতাবদল হওয়ার কথা।
কিন্তু কী বলছে বাস্তব পরিস্থিতি?
বামেদের আশা, পালাবদলের ধারাবাহিকতাই বহাল থাকবে এ বারেও। পুরভোটে ২৮টি আসনের মধ্যে দু’টি আসনে প্রার্থী পদ বাতিল হয়েছে বামেদের। ২১ নম্বর ওয়ার্ডে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন কামদুনির স্কুলশিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। তাঁকে সমর্থন করেছে বামফ্রন্ট। প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর কৃষ্ণা সেনগুপ্ত। ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ছায়া সোম, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে সনৎ বিশ্বাসের জয়ের ব্যাপারেও আশাবাদী বামেরা। সিপিএমের জোনাল কমিটির সম্পাদক তথা ১০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী খোকন মজুমদার বলেন, ‘‘পাঁচ বছরে এক দিকে ৬১টা পুকুর ভরাট, গাছপালা কেটে প্রোমোটারি আর অন্য দিকে পরিবেশ মেলা করেছে বিগত পুর-বোর্ড। মানুষ সব বুঝছেন। বোর্ড আমরা যে পাচ্ছি, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।’’ যার পাল্টা তৃণমূল বলছে, পরিবেশের হাল ভাল না খারাপ, তা এলাকায় এলে স্বচক্ষেই দেখা যাবে। খোকনবাবুর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূল নেতা অরবিন্দ মিত্র ওরফে গনা। অরবিন্দবাবু বলেন, ‘‘আর ক’দিন বাদেই ওদের মোহভঙ্গ হবে।’’
১ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের সরাসরি লড়াই কংগ্রেসের পূর্ণিমা দে-র সঙ্গে। এ বার অর্ধেক আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছে কংগ্রেস। পূর্ণিমাদেবীর দাবি, ‘‘মানুষের ক্ষোভ রয়েছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। যে ক’টি ওয়ার্ডে আমরা প্রার্থী দিয়েছি, সব ওয়ার্ডেই ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।’’ ২৭টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি। ১ নম্বরের মতোই ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের সঙ্গে সরাসরি লড়াই বিজেপির। বিজেপি প্রার্থী দেবশ্রী ঘোষ বলেন, ‘‘এটা ভোট হচ্ছে? আমাদের যা-তা ভাবে ভয় দেখাচ্ছে। পোলিং এজেন্ট না দেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। হোর্ডিং ছিঁড়ে ফেলেছে। মানুষকে ওরা শান্তিতে ভোটটা দিতেও দেবে না!’’
‘মানুষ?’ পাল্টা প্রশ্ন করেন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভুতো। বলেন, ‘‘ওরা ভূত দেখছে। বিজেপি, কংগ্রেসের কথা বাদ দিন! সিপিএমের এক জনকেও মানুষ এই ক’বছরে কোনও কাজে দেখেছে কি?’’ তৃণমূলের হয়ে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে সুদীপ মিত্র, ২৩ নম্বরে প্রকাশ রাহা, ২২ নম্বরে রীতা পালের মতো স্থানীয় নেতারা দাঁড়িয়েছেন। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী নিমাই ঘোষ বলেন, ‘‘এই সব ক’টি ওয়ার্ড ঘুরে দেখে কেউ যদি বলে কাজ হয়নি, আমাদের দেখা পাওয়া যায় না, তা হলে বুঝব। নিন্দুকও তা বলবে না।’’
ট্র্যাডিশনের রেকর্ড এ বার ভাঙবে, দাবি বিদায়ী চেয়ারম্যান তথা মধ্যমগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক রথীন ঘোষের। তাঁর কথায়, ‘‘ঔদ্ধত্য সিপিএমকে শেষ করেছে। কী কী করেছি, সে ফিরিস্তি দেব না। সাধ্যমতো পরিষেবা দেওয়া, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। এ বার লক্ষ্য আরও উন্নততর পরিষেবা।’’
আত্মবিশ্বাসের পাশাপাশি যেন একটা স্বস্তির ভাব চোখেমুখে। ক’দিন আগে বসিরহাট বিধানসভা নির্বাচনে অসুস্থ শরীর নিয়ে ছোটাছুটির অন্ত ছিল না। বনগাঁ লোকসভা ভোটেও মুখে ছিল চিন্তার ভাঁজ। সোমবার মধ্যমগ্রামে জেলা পার্টি অফিসে অবশ্য ‘সদা হাস্যমুখ’ সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। পাশে বসে থাকা বিজয় দাসের পিছনে লাগছেন, খুনসুটি করছেন। দলের জন্মলগ্ন থেকে ‘এতটা নিশ্চিন্তের ভোট’ কখনও দেখেননি জ্যোতিপ্রিয়বাবুও।