চায়ের-কাপে-তুফান: রাজনৈতিক চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মত বিনিময় এলাকাবাসীর। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
সীমান্তবর্তী ব্লক বাগদা। পরিবহণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদি নিয়ে জর্জরিত ব্লকের বাসিন্দারা। লোকসভা ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। চায়ের দোকানের আড্ডায় ফিরে-ফিরে আসছে ভোট এবং সেই সূত্রে চাওয়া-পাওয়ার খতিয়ান। বাগদার হেলেঞ্চা এলাকায় আনন্দদার (আনন্দ ঢালি) চায়ের দোকানেও জমে উঠেছে আড্ডা। এখানে আড্ডা জমিয়েছেন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক, ঠিকাদার, চিকিৎসক। তাঁদের আলোচনাতেও ভোটের রঙ।
প্রবীর কীর্তনীয়া (পার্শ্বশিক্ষক): ‘‘আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি দু’টি। এক, বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালটিকে স্টেট জেনারেল হাসপাতালে উন্নীত করা হোক। বাগদাকে রেলপথের সঙ্গে যুক্ত করা হোক। আমাদের সাংসদ সেই দাবি পূরণ করতে পারেননি।’’
সমস্যার কথা মেনে নিয়ে অঘোরচন্দ্র হালদার (ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক) বলে উঠলেন, ‘‘সাংসদ রেলপথ করে দেবেন, এমন প্রতিশ্রুতি দেননি। তবে রেলপথ হলে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের সুরাহা হবে, তা ঠিক। এই অঞ্চলে প্রচুর আনাজ চাষ হয়। চাষিরা খেতের আনাজ সরাসরি কলকাতায় নিয়ে যেতে পারবেন। ফড়ের দৌরাত্ম্য কমবে।’’ তিনি এ-ও জানান, বিদায়ী সাংসদ মমতা ঠাকুর রেলপথ করতে পারেননি ঠিকই। তবে কেন্দ্রের উচিত ছিল কাজটা করা।
বিদায়ী সাংসদ এই এলাকায় বহু কাজ করেছেন বলে পাল্টা দাবি করে অঘোরের সংযোজন, ‘‘আমার স্কুলে মুক্তমঞ্চ তৈরির জন্য উনি ৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন।’’
চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বিপ্লব দাস (ঠিকাদার) যোগ করেন, ‘‘বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালের পরিকাঠামো কিন্তু আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে।’’ এ কথা মেনে নিয়েও পেশায় শিক্ষক বিপ্লব বিশ্বাস বলেন, ‘‘হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়াতে হবে।’’ স্থানীয় সিঙ্গি এলাকার সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি যোগ করেন, ‘‘কোদালিয়া নদীর উপর এখনও বাঁশের সাঁকো রয়েছে। সেখানে সেতুর দাবি বহুদিনের।’’
এই সূত্রেই পেশায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক নিখিল অধিকারী বলেন, ‘‘ছোটবেলায় দেখেছি রাস্তায় একহাঁটু কাদা থাকত। যাতায়াত করা যেত না। গত ৬-৭ বছরে অনেক রাস্তাই পাকা হয়েছে। অলিগলিতেও ঢালাই রাস্তা হয়েছে। আর কাদা দেখি না।’’
আড্ডাটা যেহেতু বাগদায় হচ্ছে সেহেতু নেতাদের দলবদল নিয়ে কথা উঠবেই। বাগদার বিধায়ক দুলাল বর সম্প্রতিক সময়ে একাধিক বার দলত্যাগ করেছেন। শেষমেশ বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। আড্ডায় উঠে এল নেতাদের দলত্যাগ, নৈতিকতা, মূল্যবোধের কথা। প্রসঙ্গটা তুললেন নিখিল ‘‘এখন শিক্ষিত, সৎ, মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা রাজনীতি থেকে কমছে। রাজনীতিতে দুষ্কৃতীরা প্রভাব বিস্তার করছে।’’ তাঁকে সমর্থন করে বিপ্লব বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীরাই রাজনৈতিক মুখ হয়ে যাচ্ছে। ফলে যা হওয়ার তাই ঘটছে।’’
প্রবীর বলেন, ‘‘দল বদল করা নেতাদের সম্পর্কে মানুষকে সচেতন হতে হবে।’’ ওই বিষয়ে বিপ্লব দাস বলেন, ‘‘মুকুল রায়, অর্জুন সিংহেরা এখন সাধু। অথচ ‘মুকুল চোর’, ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ স্লোগান কারা দিয়েছিল, ভুলে গেল সকলে?’’
আড্ডায় কিছুটা উত্তেজনা আনলেন সুমনকুমার মজুমদার (চিকিৎসক)। তিনি বললেন, ‘‘মানস ভুইঞার বিরুদ্ধে আগে বেশ কিছু মামলা ছিল। যেই তিনি শাসকদলে গেলেন, ব্যস, আর মামলার গুঁতো নেই!’’ চায়ের আড্ডায় বিতর্ক থাকবে না তা হয় না কি! সুমনের মন্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে পাশ থেকে কয়েকজন উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘‘বলুন দেখি, মানসের বিরুদ্ধে কী কী মামলা ছিল?’’ শান্ত ভাবে সুমন শুধু বলেন, ‘‘দল পরিবর্তন ভারতীয় রাজনীতির পরম্পরা। সুযোগসন্ধানীরা এই সুযোগ বরাবরই নেন।’’ প্রবীর বলেন, ‘‘নীতি আদর্শে বিশ্বাসী নন, এমন রাজনৈতিক লোকজনকে আমাদেরই বর্জন করা উচিত।’’
তা হলে কেমন প্রার্থীকে ভোট দেওয়া উচিত— এমন প্রশ্নও আলোচনায় উঠল। অঘোর বলেন, ‘‘যাঁকেই আমরা নির্বাচিত করি না কেন, দেখতে হবে, তিনি যেন সৎ হন, তাঁর ভাবমূর্তি যেন স্বচ্ছ হয়। নিখিল বলেন, ‘‘সাংসদ যিনিই নির্বাচিত হন, তাঁকে সংসদে গিয়ে এলাকার সমস্যা তুলে ধরতে হবে।’’
চাওয়া-পাওয়া নিয়ে একটা হিসেব উঠে এলই। অঘোর শুরু করলেন, ‘‘পাঁচ বছর আগে আমাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বছরে ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেওয়া হবে। বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে আনা হবে। গরিব মানুষদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে কোনও প্রতিশ্রুতিই পূরণ হয়নি।’’
এতক্ষণে বার দু’য়েক চা দিয়ে গিয়েছেন আনন্দ। ফের একবার চা নিয়ে হাজির তিনি। এমন রাজনৈতিক আড্ডা শুনে তিনিও অনেক কিছু জানতে পারলেন বলে জানালেন।