ছবি পিটিআই।
লোহার গ্রিল ঘেরা স্কুলের লম্বা বারান্দা। এ পারে জনা কয়েক মানুষ। ওপারের লাইন কিন্তু সর্পিল। এঁকেবেঁকে স্কুলের মাঠ ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে বহু দূরে। স্থান বসিরহাটের মেরুদণ্ডি এলাকা। মাসকয়েক আগে এনআরসি আতঙ্কে ঠিক ওই এলাকাতেই রেশন বা ভূমি রাজস্ব দফতরের অফিসে এমনই লম্বা লাইন পড়ছিল। এ লাইন অবশ্য ভিন্ রাজ্য থেকে ফেরা শ্রমিকদের। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে বাচ্চা কাঁখে মহিলা— সকলেই গা ঘেঁষাঘেষি করে রোদ মাথায় নিয়ে সে লাইনে দাঁড়ানো। সকলেই এসেছেন লালারসে নমুনা সংগ্রহ করা হবে বলে।
পরিযায়ী শ্রমিকেরা ফিরতে শুরু করার পরে দুই ২৪ পরগনার অবস্থা কতকটা এমনই। স্কুল-নিভৃতবাস কেন্দ্র নিয়েও গোলমাল অব্যাহত। কোথাও পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি থেকে নিভৃতবাসে খাবার আনতে বলা হচ্ছে, কোথাও বাড়ি থেকে নিভৃতবাসে আনাই যাচ্ছে না ভিন্ রাজ্য থেকে ফেরা শ্রমিকদের। সব মিলিয়ে রোজই নতুন উপসর্গ আমদানি হচ্ছে পরিযায়ী সমস্যায়। সব থেকে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে ভিন্ রাজ্য থেকে ফেরা মানুষদের। দু’মাস যন্ত্রণা ভোগ করার পরে, এলাকায় ফিরেও হয়রানি কমছে না তাঁদের। তার উপরে রয়েছে করোনা-আতঙ্ক। তবে উল্টো ছবিও রয়েছে। অনেকেই নিভৃতবাস কেন্দ্র এড়াতে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারই মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের আক্রান্ত হওয়া অব্যাহত। সোমবার নতুন করে বনগাঁয় সাত জন এবং বসিরহাটে আট পরিযায়ী শ্রমিক আক্রান্ত হয়েছেন।
বনগাঁ মহকুমার গোপালনগর এলাকায় শ্বশুর-বৌমার রিপোর্ট পজিটিভ হয়েছে। তাঁরা সম্প্রতি মহারাষ্ট্র থেকে ফিরেছিলেন। গাইঘাটা ব্লকে চার জনের রিপোর্ট পজিটিভ। এই নিয়ে মহকুমায় মোট ৩৯ জন পরিযায়ী শ্রমিক আক্রান্ত হলেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের একটি দল গাইঘাটা এলাকায় নিজেদের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। পুলিশ গিয়ে তাদের স্কুল-নিভৃতবাস কেন্দ্রে নিয়ে আসে। গাইঘাটার একটি নিভৃতবাস কেন্দ্রে খাবার মিলছে না বলে অভিযোগ। প্রশাসন সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে।
বসিরহাটের আট আক্রান্তদের মধ্যে চার জন স্বরূপনগরের। বাকিরা হাড়োয়া ও বাদুড়িয়ার। তারা সকলেই মুম্বইতে কাজ করতেন। এই নিয়ে গত তিন দিনে ২০ জন পরিযায়ী শ্রমিক আক্রান্ত হলেন। যা প্রশাসনের কাছে বাড়তি চিন্তার। বসিরহাট স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক দেবব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “আক্রান্তদের অধিকাংশই উপসর্গহীন।” তবে স্বাস্থ্য দফতরকে চিন্তায় রেখেছে অন্য একটি বিষয়। আমপানে তছনছ হওয়া এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের বাড়িঘর-খাবার নিয়েই বেশি চিন্তিত। মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোওয়া আপাতত সেই এলাকায় শিকেয় উঠেছে। পরিযায়ীদের তাঁদের থেকে আলাদা না রাখতে পারলে সংক্রমণ আদৌ ঠেকানো যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশাসন চিন্তিত। মিনাখাঁ, টাকি, রুদ্রপুর, গোপালপুরে এবং একটি ভ্রাম্যমান গাড়িতে লালারস সংগ্রহ করা হচ্ছে। লোকাভাবে সকলের লালারস সংগ্রহ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ।
হাসনাবাদ থানার ধরমবেড়িয়া গ্রামের ছ’জনকে মঙ্গলবার বিশপুর হাইস্কুলে আনা হয়। তাঁরা যে যার নিজের বাড়িতেই ছিলেন। তাঁদের অভিযোগ, স্কুলের দুটো ঘর শুধুমাত্র খুলে দেওয়া হয়েছে। আলোর ব্যবস্থা নেই। শৌচাগারে তালা ঝুলছে। ফলে সমস্যায় পড়ছেন মহিলারা। এমনকি, তাঁদের বাড়ি থেকে খাবার আনতে বলা হয়েছে। বিশপুর পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্জিত জানা বলেন, “এ দিন খাবারের কোনও ব্যবস্থা করা যায়নি। বুধবার থেকে তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।”
মঙ্গলবার ক্যানিং মহকুমায় বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রায় সাড়ে চারশো পরিযায়ী শ্রমিক ফিরেছেন। উপসর্গ থাকায় কয়েকজনকে সসরকারি নিভৃতবাস কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তাঁদের লালারসও সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকিদের গৃহ-নিভৃতবাসে থাকতে বলা হয়েছে। এদিন ক্যানিং কোভিড হাসপাতাল দু’জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এদিন সকালে কেরালা থেকে প্রায় ১৩৭ জন শ্রমিকের একটি দল কুলতলি এসে পৌঁছয়। তাঁদের গৃহ-নিভৃতবাসে পাঠানো হয়েছে।