কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ফাইল চিত্র
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়ানের সঙ্গে সঙ্গে একটা যুগের অবসান হল। এই বিষাদঘন মুহূর্তে একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে— রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুশীলনের মধ্যে ভদ্র, মার্জিত, আপাদমস্তক সৎ, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষেরা কি নেহাৎই বেমানান! আসলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেই বিরল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি সারা জীবন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে সততা ও মূল্যবোধের চর্চা করে গিয়েছেন।
এক বছর আগে-পরে আমাদের জন্ম। আমার ১৯৪৩, ওঁর ১৯৪৪। বামপন্থী রাজনৈতিক ঘরানার প্রেক্ষিতে আমাদের দু’জনের ধরন কিছুটা ভিন্ন ছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র হওয়ার গৌরব তথা পার্টির বুদ্ধিজীবী মহলে বুদ্ধবাবুর ছিল অবাধ যাতায়াতের সুযোগ। আমি ছিলাম উদ্বাস্তু পরিবারের অতি সাধারণ এক জন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক সহজ ছিল, তবে সরল ছিল না। দশ বছর তাঁর নেতৃত্বে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসাবে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। সব বিষয়ে সহমত হয়েছি বললে ঠিক বলা হবে না। কিছু ক্ষেত্রে প্রথমে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে সহকর্মী হিসাবে আপন করেই নিয়েছিলেন।
এই সময়কালে সুন্দরবনের প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। মুড়িগঙ্গার উপরে সেতু তৈরির কাজের পরিকল্পনাও অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। তবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। এ আক্ষেপ ওঁর ছিল। ২০০৯ সালে বুদ্ধবাবুর উদ্যোগেই প্রথম অনগ্রসর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সাইকেল প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে সুন্দরবনের পিছিয়ে পড়া অংশের পড়ুয়াদের প্রথম সাইকেল দেওয়া হয়েছিল। বুদ্ধদেববাবু প্রচার বিমুখ ছিলেন। প্রায়শই সহকর্মীদের বলতেন, ‘আমাদের পা থাকবে মাটিতে, মাথা থাকবে আকাশে।’ এক জন কমিউনিস্ট কর্মীর এটাই সঙ্কল্প (কনভিকশন)।
২০১৪ সালে রায়দিঘির খাঁড়ি অঞ্চলে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দলে চার জন নিহত হন। আমাদের পার্টির জেলা কমিটির সদস্য সহ বহু নেতাকে বিনা বিচারে আটক করা হয়। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য বিধানসভায় ‘মোশন’ পর্যন্ত আনা হয়। কৃষ্ণচন্দ্রপুর স্কুল মাঠে আমরা আয়োজন করেছিলাম বিশাল জনসভার, প্রধান বক্তা বুদ্ধদেব ভট্টচার্য। কিন্তু শারীরিক ধকল নিতে পারবেন না বলে বুদ্ধবাবু সম্মতি দিতে চাইছিলেন না। সে দিন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অফিসে গিয়ে বুদ্ধবাবুর মুখোমুখি বসে নাগাড়ে তর্ক করে গেলাম। শেষে শারীরিক অসুবিধা সত্ত্বেও সেই জনসভায় বুদ্ধদেববাবু প্রধান বক্তা হয়ে এসেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর শুরু থেকেই অন্যতম মেন্টরের ভূমিকা পালন করেছিলেন উনি। অনেকে উপহাস করেছিলেন। তখন বুদ্ধবাবু আমাকে সাহস জোগান।
বুদ্ধবাবু বাংলার বেকার যুবকদের জন্য কাজের সংস্থান তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। হতে পারে কিছু গলদ ছিল, আমলাতান্ত্রিক অতিসক্রিয়তা ছিল। কিন্তু বুদ্ধবাবুর সদিচ্ছা ও কনভিকশন (সঙ্কল্প) নিয়ে কোনও দ্বিধা ছিল না।
সিঙ্গুরের অটোমোবাইল উপনগরী ও নয়াচরের পেট্রোকেমিক্যাল হাবের প্রস্তাব এনে বুদ্ধবাবু একটা ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয়, গত চোদ্দো বছরে একটা নতুন বাইপাসের পরিকল্পনা হয়নি, হয়নি কোনও শ্রমনিবিড় কলকারখানা, এমনকী আয়লা পরবর্তী সুন্দরনের বাঁধ নির্মাণ একচুলও এগোয়নি। বাঁধের কেন্দ্রীয় বরাদ্দ টাকা ফেরত গিয়েছে। লোক খেপিয়ে বাঘের পিঠে ওঠা যায়, কিন্তু সেই বাঘের পিঠ থেকে নামা কি অত সহজ! আজকের পশ্চিমবঙ্গবাসী হাড়ে হাড়ে সেই সত্য অনুধাবন করছেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রচলিত ক্ষমতার অনুশীলনের ছককে ভাঙতে চেয়েছিলেন। তিনি এক অবিস্মরণীয় ব্যতিক্রম। তাই বলে তাঁর সীমাবদ্ধতা যে নেই, তা নয়। তিনি শালগ্রাম শিলা নন। প্রশাসক হিসাবে কখনও কখনও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন।