বাঁ দিক থেকে, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, পুলিনবিহারী রায় এবং শঙ্কর ঠাকুর। নিজস্ব চিত্র।
ইনি বলছেন, ‘‘পরিবারের প্রাণপুরুষ তো আমার নাম রেখেছিলেন।’’ ওঁর ঝুলি থেকে বেরোচ্ছে মতুয়া ধর্মের উপরে নিজের লেখা বই। আবার কেউ প্রমাণ করতে ব্যস্ত, ‘‘আমার দাদু ছিলেন ওঁর প্রধান শিষ্য।’’
যে পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রমাণের এমন চেষ্টা, সেটা গাইঘাটার ঠাকুরনগরের ঠাকুর পরিবার। মতুয়া ধর্মের পীঠস্থান।
ডান-বাম সব পক্ষ বরাবরই মতুয়া বাড়িকে রাজনীতির নিরিখে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। এ বার মতুয়া অধ্যুষিত গাইঘাটা কেন্দ্রের প্রার্থীরাও সেই জুতোয় পা গলিয়েছেন। মতুয়া বাড়ির ‘বড়মা’র আশীর্বাদ না পেলে ভাগ্যের শিকে ছেঁড়া মুশকিল, বিলক্ষণ বুঝে নিয়েছেন সকলে। তফসিলি সংরক্ষিত গাইঘাটা আসনে তফসিলিদের বড় অংশই মতুয়া ধর্মাবলম্বী। এমনিতে রাজ্যের ৭২টি বিধানসভা কেন্দ্রে মতুয়া ভোটার ছড়িয়ে আছেন বলে দাবি মতুয়া মহাসঙ্ঘের। যার মধ্যে বনগাঁ মহকুমার ৪টি বিধানসভা আসনও পড়ে। গাইঘাটায় মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ি যেহেতু তাদের ধর্মস্থান, ফলে এই কেন্দ্রে মতুয়া ধর্মাবলম্বীদের প্রভাব ভালই।
তৃণমূল প্রার্থী পুলিনবিহারী রায়ের কথাই ধরা যাক। বনগাঁর বাকি তৃণমূল প্রার্থীদের মতোই সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপানিদেবীর (বড়মা) আশীর্বাদ নিয়ে এসেছেন তিনি। প্রচারে বেরিয়ে থেকে থেকেই ভোটারদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘আমিও হরি ভক্ত।’’ মতুয়ারা সকলেই হরিচাঁদ ঠাকুরের নামগান করেন। নিজেকে ‘হরিভক্ত’ বলে প্রমাণ করার দায় আছে তাঁর। হরিচাঁদের নাম নেওয়ার পরেই যাঁর কথা বলছেন পুলিনবাবু, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিনবাবু ভোটারদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ঠাকুরবাড়ির জন্য কত বছর ধরে উন্নয়নের ধারা বইয়ে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের সঙ্গে নিজের পুরনো ঘনিষ্ঠতার দু’চার কথাও উঠে আসছে পুলিনবাবুর কথায়। আরও উঠছে সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের কথা। তিনি মতুয়া-বাড়ির বড় বৌ বলে কথা! আরও বলছেন, মতুয়া ধর্মের প্রাণপুরুষ গুরুচাঁদ ঠাকুর নাকি তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘গুরুচাঁদ।’ পুরনো কাসুন্দি কখন কোন কাজে লেগে যায়!
তবে তৃণমূল নেতারা ভুলেও মুখে আনছেন না কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের প্রসঙ্গ। মমতাবালার স্বামী, প্রয়াত কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর তৃণমূলের টিকিটে বনগাঁর সাংসদ হয়েছিলেন। কপিলবাবু মতুয়া বাড়ির বড়ছেলে বলে কথা। দলের প্রাক্তন সাংসদ। কিন্তু তাঁর নাম তৃণমূলের প্রচারে তেমন উঠছে কই!
ব্যাখ্যা দিচ্ছে তৃণমূলেরই একাংশ। তারা জানাচ্ছে, কপিলকৃষ্ণের নাম এই বাজারে মুখে আনা মুশকিল। কারণ, সিপিআই নাকি ওই নামমাহাত্ম্যে মজে যাঁকে দাঁড় করিয়েছে এই কেন্দ্রে, তাঁর নামও কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর! আড়ালে আবডালে যুক্তিটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বাম নেতৃত্বের একাংশও। প্রার্থী জানাচ্ছেন, প্রয়াত সাংসদের সঙ্গে তাঁর কতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল, সে সব কথা। মতুয়া পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা কতটা, সে কথা প্রমাণেও মরিয়া তিনি। প্রচারে বেরিয়ে মাঝে মধ্যেই ঝুলি থেকে বের করছেন, মতুয়াদের নিয়ে লেখা তাঁর বই। বড়মার আশীর্বাদ নিয়ে প্রচারে বেরিয়ে বলছেন, ‘‘মতুয়া সমাজের ভোট পেয়ে, তাঁদের আশীর্বাদ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু তাঁর কাছে থেকে মতুয়ারা প্রাপ্ত মর্যাদা ও সম্মান পাননি। তৃণমূল সরকার মতুয়া ধর্মের দুই প্রাণ পুরুষ হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামে বাম সরকার যে পুরস্কার চালু করেছিল, তা বন্ধ করে দিয়েছে। ঠাকুরবাড়িতে বিভেদ তৈরি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই অভিযোগও শোনা যাচ্ছে কপিলকৃষ্ণবাবুর প্রচারে।
পিছিয়ে নেই বিজেপিও। একে তো মতুয়া মহামেলায় তৃণমূলের বড় নেতারা কেউ হাজির না হওয়ায় সমালোচনার ঝড় তুলছেন তাঁরা। স্থানীয় নেতাদের বক্তব্য, নাগরিকত্ব নিয়ে মতুয়াদের দেওয়া কথা রাখতে না পেরেই মেলার পথ মাড়াননি শাসক দলের উপরতলার নেতারা। প্রার্থী শঙ্কর ঠাকুর অবশ্য এখনও জুতসই প্রচার শুরু করতে পারেননি। তবে তিনিও মতুয়া পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রমাণের চেষ্টায় ত্রুটি রাখছেন না। প্রার্থীর কথায়, ‘‘ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা প্রমথরঞ্জন ঠাকুর আমার ঠাকুরদাদা কাশী ঠাকুরের সঙ্গে ঠাকুরনগরে এসেছিলেন। গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রধান শিষ্য ছিলেন আমার ঠাকুরদাদা। আমি নিজেও মতুয়া। প্রচারে ওই বিষয় তুলে ধরব।’’ মতুয়া পরিবারের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই কোনও প্রার্থীর। কিন্তু রাজনীতির সে যুক্তি শোনার দায় কোথায়!