মাল্যদান বরুণ বিশ্বাসের মূর্তিতে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
মৃত্যুর ঠিক আগের দিনের ঘটনা। এলাকার বাসিন্দা একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া এক ছাত্রী টাকার অভাবে বইপত্র কিনতে পারছিল না। ছাত্রীর বাবা হিতলাল বাইন বুকলিস্ট নিয়ে গিয়েছিলেন বরুণ বিশ্বাসের কাছে। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে বরুণ ওই ছাত্রীর সব বই কিনে দেন।
পর দিনই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান গাইঘাটার সুটিয়ার শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস। সুটিয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী বরুণকে এখনও ভুলতে পারেন না এই এলাকার বহু মানুষ।
গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের বই কিনে দেওয়া, টিউশন ফি দেওয়া, নিজে পড়ানো, জামাপ্যান্ট কিনে দেওয়াটা ছিল বরুণের নিয়মিত কাজ। গরিব পরিবারের মেয়েদের নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছেন। খরচখরচা সব নিজের কাধে তুলে নিতেন বলে জানাচ্ছেন পাড়া-পড়শিরা। এ সব কাজ করতে গিয়ে নিজের বেতনের প্রায় সব টাকাটাই চলে যেত। উল্টে ধারদেনাও করতে করতে হত। তবু মানুষের বিপদে আপদে সব সময়ে পাশে ছিলেন বরুণ।
বন্যা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে বরুণের নাওয়া খাওয়ার সময় থাকত না বলে জানালেন অনেকেই। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খাবার ব্যবস্থা করতেন। চাল ডাল কিনে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন। বিভিন্ন সংগঠন বা মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে এসে মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতেন।
করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে গ্রামের মানুষের কাজকর্ম বন্ধ। রুজিরোজগার হারিয়ে অভাবে দিন কাটছে অনেকেরই। মরার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের মতো আমপানের দাপটে বাড়িঘর হারিয়ে অনেক মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে সুটিয়াবাসীর এখন আরও বেশি করে বরুণকে মনে পড়ছে। তাঁরা মনে করছেন, বরুণ বেঁচে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। ত্রাণের ব্যবস্থা করতেনই। হিতলাল বলেন, ‘‘আমরা এক সঙ্গে প্রতিবাদী মঞ্চের হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতাম। মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখে বরুণ নিজেকে ধরে রাখতে পারতেন না। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আজ আমার মতো সুটিয়ার মানুষ বরুণের অভাব বোধ করছেন।’’ সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের তরফে রবিবার বরুণের মৃত্যু দিনে সুটিয়ায় স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল। ২০১২ সালের ৫ জুলাই গোবরডাঙা স্টেশন চত্বরে দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হন কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের (মেন) বাংলার শিক্ষক তথা সুটিয়া গণধর্ষণের ঘটনার অন্যতম প্রধান সাক্ষী বরুণ। প্রতিবাদী মঞ্চ সূত্রে জানা গিয়েছে, স্থানীয় যমুনা নদীর সংস্কারের টাকা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন বরুণ। তৎকালীন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার কাছেও অভিযোগ করেছিলেন। মঞ্চের সভাপতি ননী গোপাল পোদ্দার বলেন, ‘‘লকডাউন ও আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে বরুণ অবশ্যই দাঁড়াতেন। আমরা খুব মানসিক কষ্ট পাচ্ছি, বরুণের কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে না পেরে।’’
বরুণের দিদি প্রমিলা রায় সর্বক্ষণ ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য কাজ করতেন। তিন বলেন, ‘‘আমপানের সরকারি টাকা নিয়ে দুর্নীতির যে ঘটনা ঘটছে, ভাই বেঁচে থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করত।’’ আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন মহিলা বলছিলেন, ‘‘এই দুঃসময়ে আমাদের কেউ দেখার নেই। ক্ষতিপূরণের টাকা পর্যন্ত পেলাম না। আমাদের হয়ে বলার কেউ নেই। বরুণ থাকলে নিজেদের এতটা অসহায় লাগত না।’’
৯ বছর অতিক্রান্ত। আজও বরুণের খুনিদের সাজা হয়নি। বিচারপর্ব কার্যত থমকে। ননীগোপাল বলেন, ‘‘বিচার প্রক্রিয়ার গাফিলতির কারণেই দোষীরা আজও সাজা পায়নি। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করুন।’’ প্রমিলা বলেন, ‘‘এই সরকারের কাছ থেকে আমরা প্রকৃত খুনিদের সাজার আশা করি না।’’
বরুণ বিশ্বাসের খুনের মামলা চলছে বনগাঁ মহকুমা আদালতে। আদালতের মুখ্য ভারপ্রাপ্ত সরকারি আইনজীবী সমীর দাস বলেন, ‘‘অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারকের (ফাস্ট ট্র্যাক-১) পদ কয়েক মাস ফাঁকা রয়েছে। বিচারক না থাকায় বিচার প্রক্রিয়া ধীরে চলছে। আমরা চেষ্টা করছি, দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করে দোষীদের সাজার ব্যবস্থা করতে।’’