শোভা সরকার
যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন প্রসূতি। শুরু হয়েছে রক্তপাত। সন্তানের মাথা বেরিয়ে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, শিশুটির শরীরে নাড়ি জড়িয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি বিপজ্জনক। দ্রুত প্রসবের করাতে না পারলে মা-শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল। অথচ সরকারি নিশ্চয় যান তখনও এসে পৌঁছয়নি। গাড়ি এলেও নিকটবর্তী হাসপাতালে যেতে যেতে আরও ঘণ্টাখানেক তো বটেই।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য অঘটন কিছু ঘটেনি। এক মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী সাহস দেখিয়ে নিজেই ঝুঁকি নেন। বাড়িতেই সন্তানের প্রসব করিয়েছেন তিনি। পরে মা ও সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সুস্থ আছে দু’জনেই।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাটি ঘটেছে গাইঘাটা ব্লকের ঘোঁজা এলাকায়। মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী শোভা সরকারের প্রশংসা করছেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। গাইঘাটার বিএমওএইচ সুজন গায়েন বলেন, ‘‘উনি খুবই মানবিক কাজ করেছেন। শিশুর গলায় নাড়ি জড়িয়ে গিয়েছিল। প্রসব করানো ছিল যথেষ্ট ঝুঁকির। ওই কাজ স্বাস্থ্যকর্মীটি দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। ওই সময়ে দ্রুত প্রসব করানো না হলে সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল।’’
বছর তিরিশের শোভা ঘোঁজা উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এএনএম হিসেবে কর্মরত। গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রসূতি মায়েদের খোঁজ-খবর রাখা, ওষুধ-ইঞ্জেকশন দেওয়ার কাজ করেন। তাঁর অধীনে চার জন আশাকর্মী আছেন।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার বেলা ৩টে নাগাদ কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন শোভা। পথে দেখেন, একটি বাড়ির সামনে মহিলাদের জটলা। এগিয়ে গিয়ে জানতে পারেন, ওই বাড়ির প্রসূতি রিতা অধিকারীর প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন তরুণী। জানুয়ারি মাসে প্রসবের কথা ছিল। কিন্তু সময় এগিয়ে এসেছে। শোভা দেখেন, মহিলার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সন্তানের মাথা বেরিয়ে আসছে।
পরিবারের লোকজন রিতাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন বলে সরকারি গাড়ি পাওয়ার জন্য ১০২ নম্বরে ফোন করেছিলেন। কিন্তু ওই গাড়ি আসতে তখনও মিনিট ২০ দেরি। এ দিকে, সন্তানের গলায় নাড়ি জড়িয়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সকলেই। শোভা সিদ্ধান্ত নেন, যে ভাবেই হোক সন্তানকে বাঁচাতেই হবে। ফোনে ঘটনার কথা জানান বিএমওএইচকে। স্বাস্থ্যকর্তা তাঁকে ভরসা জোগান।
কিছুক্ষণের চেষ্টায় শোভা প্রসব করান রিতার। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শোভার স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া থাকলেও সন্তান প্রসব করানো তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। স্বাস্থ্য দফতরও সে কাজের খাতায়-কলমে অনুমতি দেয় না। শোভার নিজের সে অভিজ্ঞতাও ছিল না। সুজন বলেন, ‘‘উনি যে কাজ করেছেন, তা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছেও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, শিশুটির গলায় নাড়ি জড়িয়ে গিয়েছিল। স্বাস্থ্য কর্মীদের এই ধরনের মানবিক কাজ গ্রামাঞ্চলে আমাদের কর্মীদের উৎসাহ জোগাবে।’’ কী বলছেন শোভা? তাঁর কথায়, ‘‘চাকরি জীবনে বড় অভিজ্ঞতা লাভ হল। চোখের সামনে যখন দেখলাম, প্রসূতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সন্তানের মাথা বেরিয়ে আসছে, গলায় কর্ড জড়ানো— তখন সিদ্ধান্ত নিই যা-ই ঘটুক না কেন, কাজটা আমাকে করতেই হবে। প্রথমে ভাবে একটু ভয় ভয় করছিল। কিন্তু সন্তানকে মায়ের বুকে দিতে পেরে কী যে আনন্দ হচ্ছেস তা বলে বোঝাতে পারব না।’’
রিতা বলেন, ‘‘শোভা দিদি না এলে কী হত জানি না। ওঁর জন্যেই আজ মেয়েকে পেলাম।’’