এই সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
ঘড়িতে সময় সকাল সাড়ে ৮টা। বনমালিপুর গ্রামের কবিতা মণ্ডল তাঁর চার বছরের ছেলে সুমনকে প্রতিষেধক দিতে এসেছেন জয়নগর-মজিলপুর মাতৃমঙ্গল শিশুমঙ্গল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন। সন্তান কোলে মহিলাদের ভিড়। সকাল ৯টার মধ্যে চিকিৎসক আসারা কথা। কিন্তু চিকিৎসক যখন ঢুকলেন, ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছুঁয়েছে। ততক্ষণে রোদে পুড়ে হাসফাঁস অবস্থা সকলের। খাবার জল মেলা দুষ্কর। কেননা, নলকূপ খারাপ। চিকিৎসা নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই মানুষের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা, জয়নগর-মজিলপুর পুরসভা পরিচালিত এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিজেই ‘নেই’ রোগে আক্রান্ত। দিনের পর দিন তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে এলাকারা মানুষকে। অথচ প্রতিটি নির্বাচনের সময় সব দলের প্রার্থীই স্বাস্থ্যকেন্দ্র উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। আশায় বুক বাধেন এলাকাবাসী। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুরসভার উদাসীনতাতেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির এই দশা।
১৪৬ বছর আগে জয়নগর পুরসভা গড়ে ওঠে। তার কয়েক বছর পরে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের থানার মোড়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালু হয়েছিল। মূলত গর্ভবতী ও প্রসূতি মহিলাদের কথা ভেবেই এটি চালু করা হয়। পরবর্তীকালে পরিষেবা বাড়ানো নিয়ে নানা পরিকল্পনা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা আর হয়ে ওঠেনি। ১০ শয্যার স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে এখন তিন জন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন প্রসূতি বিশেষজ্ঞ। একজন অ্যানাস্থেটিস্ট। এক জন জেনারেল চিকিৎসক। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, বর্তমানে এখানে একজন মেডিক্যাল অফিসার, ফার্মাটিস্ট, নার্স এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর প্রয়োজন। মেডিক্যাল অফিসার সুনির্মল মণ্ডল বলেন, ‘‘পরিকাঠামো ও পরিচালনার অভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে অসুবিধা হচ্ছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সব জানানো হয়েছে।’’
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তিনটি অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে একটি খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। এত দিন ধরে অ্যাম্বুল্যান্সের তেল পুরসভা থেকে দেওয়া হত। কিন্তু তা বন্ধ। কয়েক বছর আগে ‘বেবি ইউনিট’ চালু করার কথা হয়েছিল। সে জন্য জন্য ভবন তৈরির কাজও শুরু হয়। কিন্তু সেই কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। তাই প্রস্তাবিত বিভাগটিও চালু হয়নি। অসমাপ্ত ওই ভবনে সন্ধ্যার পর দুষ্কৃতীদের মদ-গাঁজার আসর বসে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন স্বাস্থ্যকর্মী থেকে রোগীর আত্মীয় পরিজনেরা। চিকিৎসকের অভাবে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ।
এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পানীয় জলের অভাব রয়েছে। বছর পাঁচেক একমাত্র নলকূপটি খারাপ হওয়ার পর থেকে তা আর সারানো হয়নি বলে অভিযোগ। পাশে অন্য একটি নলকূপ থাকলেও, তা পানের যোগ্য নয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীদের জন্য আলাদা কোনও শৌচাগার নেই। রোগীদের শৌচাগারই তাঁদের ব্যবহার করতে হয়। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিশ্রাম নেওয়ার ঘর পর্যন্ত নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দুই চিকিৎসককে সময় মত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাওয়া যায় না। তাঁরা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সময়মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে পারেন না। ফলে রোগীরা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হন। স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা সুকান্ত দাস, কমল বৈদ্যরা বলেন, ‘‘পাঁচ বছর আগেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি রমরমিয়ে চলত। রোজ ১৫-২০টি শিশু ভূমিষ্ঠ হত। বর্তমানে পুরসভার উদাসীনতায় পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে।’’
স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনও প্রতিষেধক নিতে গেলে রোগী পিছু ২০ টাকা নেওয়া হয়। প্রসূতিদের ক্ষেত্রে শয্যা ভাড়া এবং খাওয়া খরচ মিলিয়ে দিনে ৫০ টাকা। স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে খরচ ৮৫০ টাকা, সিজারের খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে রোগীর ভিড় কমছে। অথচ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর নির্ভর করতে হয় জয়নগর-মজিলপুর পুরসভার মহিলাদের। কুলতলি, মৈপিঠ এলাকার মহিলারাও এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরেই নির্ভরশীল ছিলেন। প্রাক্তন পুরপ্রধান প্রশান্ত সরখেল বলেন, ‘‘আমার সময়ে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৫-৬ জন চিকিৎসক ছিল। স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে কোনও সমস্যা হত না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, খুব দরকার না পড়লে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেউ আসতেই চায় না।’’
বিদায়ী পুরপ্রধান ফরিদা বেগম শেখ অবশ্য অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, ‘‘আগের থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামোর উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসকের সমস্যা নেই।’’
সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্য কথাই বলে।
—নিজস্ব চিত্র।