ফুটপাতে সীতা। নিজস্ব চিত্র
খান তিনেক বড়, আর একটি ছোট কম্বল রয়েছে তাঁদের। সংসারে লোক তাঁরা মাত্রই দু’জনই। দু’টি মানুষের জন্য চারটি কম্বলের সংগ্রহ কলকাতা বা শহরতলির শীতে বেশ ভালই বলতে হয়। তবুও ওই আদিবাসী দম্পতির সমস্যা গভীর।
আসলে ওই কম্বলগুলিই তাঁদের মহার্ঘ্য সম্বল। আর রয়েছে দু’টি থালা-বাটি, জলের বোতল, আর একটি ঝোলা। তার মধ্যে একটি শাড়ি আর লুঙ্গি। গত চার মাস ধরে ব্যারাকপুরের সুকান্ত সদনের সামনের ফুটপাতে তাঁদের সংসার। খাওয়া-বসা-ঘুম একই জায়গায়। কড়া শীতের রাতে খোলা আকাশের নীচে রাত-দিন কাটছে তাঁদের। বৃষ্টি নামলে আশপাশের কোনও ছাউনি খুঁজে নেন তাঁরা।
অথচ, ঘর তাঁদের ছিল। স্ত্রী-স্বামী মিলে রোজ সকালে কাজে বেরোতেন। ফিরতেন সন্ধ্যায়। পাঁচ মাস আগে তেমনই এক সন্ধ্যায় ফিরে দেখেন, বাড়িটাই আর নেই। পুড়ে বিলকুল ছাই তাঁদের গেরস্থালি। পরের দু’দিন কেটেছিল ছাই সরিয়ে যদি কিছু মেলে। কিন্তু কিছুই পাননি। মাসখানেক সেই ভিটেতেই কেটেছে তাঁদের। তার মধ্যে বাড়ি তৈরির জন্য অনেকের কাছে গিয়েছেন। কিন্তু, কোথাও তেমন কিছু সাহায্য মেলেনি। তার পরে সুকান্ত সদনের সামনে এসে থাকতে শুরু করেন সীতা ও লক্ষ্মণ ওঁরাও।
কিন্তু ভিটে ছেড়ে ফুটপাতে কেন?
সীতা জানালেন, ওই বাড়িতেই খোলা আকাশের নীচে দিন কাটছিল তাঁদের। কিন্তু তাঁর স্বামী আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর চিকিৎসার জন্য ব্যারাকপুর বি এন বসু হাসপাতালে গিয়েছিলেন তাঁরা। রাতবিরেতে ফের যদি আসতে হয় ভেবে হাসপাতালের সামনেই দু’দিন কাটান তাঁরা। তখন অনেকেই তাঁদের কথা জানতে পারেন। তাঁদেরই কেউ এক জন পরামর্শ দেন সুকান্ত সদনের সামনে গিয়ে থাকার। সেই শুরু।
লক্ষ্মণ-সীতার বাড়ি ছিল ব্যারাকপুরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের পানপাড়ায়। দু’জনেরই বয়স ৬০ ছাড়িয়েছে। বুধুয়া নামের তাঁদের এক ছেলেও ছিল। সীতা বলছেন, ‘‘ছিল নয়, হয়তো এখনও আছে। কিন্তু কোথায় আছে তা জানি না। কোথায় যে হারিয়ে গেল জোয়ান ছেলেটা!’’
লক্ষ্মণ জানান, বুধুয়া গাড়ি চালাত। কখনও লরি, কখনও মালবাহি ছোট গাড়ি। বছর পাঁচেক আগে এক রাতে ‘গাড়ি নিয়ে বাইরে যাচ্ছি’ বলে আর ফেরেননি তিনি। তার পর থেকে রোজ আশায় থাকতেন ওই দম্পতি যে, এক দিন তাঁদের ছেলে ঠিক ফিরে আসবে। তবে ইদানিং সে আশাতেও চিড় ধরেছে। ‘‘বাড়িটা যেমন পুড়ে শেষ হয়ে গেল, তেমন করে হয়তো ছেলেও কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।’’ আকাশে তাকিয়ে কাকে যেন খোঁজে সীতার শূণ্য দৃষ্টি।
বাড়ির জন্য কারওর কাছে সাহায্য চাননি? সীতার দাবি, পাড়ার লোকেরা যে যেখানে বা যাঁর কাছে বলেছেন, তাঁরা গিয়েছেন। কিন্তু কে কাউন্সিলর বা কে চেয়ারম্যান তিনি জানেন না। অভিযোগ, কোথাও গিয়ে কোনও লাভ হয়নি। লক্ষ্মণ বললেন, ‘‘এই যে, কম্বল, বাসন-কোসন দেখছেন, সবই কেউ না কেউ দিয়েছেন। অনেকেই সাহায্য করেন।’’ সীতা জানালেন, তিনি এখনও যে দিন যেমন কাজ পান, করেন। সুস্থ থাকলে স্বামীও কাজ জোগাড়ের চেষ্টা করেন। তবে দু’জনে এক সঙ্গে কাজে যান না। ‘সংসার’ আগলানোর জন্য এক জন থাকেন। বেশ কিছু মানুষ তাঁদের পরিচিত হয়ে গিয়েছেন। তাঁরাও সাধ্য মতো চেষ্টা সাহায্য করেন।
কিন্তু এ ভাবে কত দিন?
সীতা বলছেন, ‘‘কী করব বলুন। কোথায় আর যাব। মৃত্যু হলে এখানেই হোক।’’ ব্যারাকপুরের পুরপ্রধান উত্তম দাস বলেন, ‘‘বিষয়টি আমি জানি না। আমার চোখেও পড়েনি। অবশ্যই খোঁজ নেব। কোনও না কোনও ব্যবস্থা অবশ্যই হবে।’’ পুরপ্রধানের আশ্বাসের কথা অবশ্য জানেন না ওঁরা।