কেউ ভোটে দাঁড়িয়েছেন, ওয়ার্ডের মানুষ বাস্তবে আন্তরিক ভাবে তাঁকে কতটা ভালবাসেন, তা যাচাই করতে, কেউ বা ভোটে দাঁড়িয়েছেন স্বামীর ইচ্ছায়। কেউ আবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন, দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে। কারও স্বপ্ন রাজনীতি থেকে দুর্বত্তায়ন বন্ধ করার। ওঁরা সকলেই গোবরডাঙা পুরসভা ভোটে প্রথমবারের প্রার্থী। নতুন প্রার্থীদের মধ্যে যেমন রয়েছেন উনত্রিশ বছরের কলেজ শিক্ষিকা, আবার রয়েছেন বছর পঞ্চাশের স্কুল শিক্ষক। আছেন কৃষক, গৃহবধূও। কেউ সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, কারও এই ভোটেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তবে ভোটের ময়দানে নেমে সকলেই নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ পাচ্ছেন।
গোবরডাঙা পুরসভার ১৭টি আসনের মধ্যে সিপিএম-বিজেপি-তৃণমূল-কংগ্রেস সব দলেই এ বার নতুন মুখের ছড়াছড়ি। সাধারণ পুরবাসীও যা দেখে স্বস্তি পাচ্ছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে পুরনো মুখ দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এ বার সব দলই দেখলাম বেশি করে নতুন মুখ তুলে এনেছে। নতুন মুখের যে প্রার্থীই জিতুন, তাতে পুর উন্নয়নের কাজে গতি আসবে। দুর্নীতিও কমবে।’’ ভোটারদের বিশ্বাস, ‘‘নতুন কাউন্সিলরদের রাজনীতির অন্ধকার দিকটা সম্পর্কে জানতে কিছুটা সময় লেগে যাবে। তা ছাড়া, নিজেদের রাজনৈতিক জীবনটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে নতুন কাউন্সিলরেরা ভাল কাজ করে নিজেদের প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন। আখেরে তাতে এলাকার মানুষ উপকৃত হবেন।’’
পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তৃণমূলের প্রতীকে এ বার লড়ছেন বছর উনত্রিশের রত্না বিশ্বাস চৌধুরী। তিনি স্থানীয় গোবরডাঙা হিন্দু কলেজের গেস্ট লেকচারার। রত্নাদেবী ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। দল তাঁকে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী করেছে। দলীয় সূত্রের খবর, ১২ নম্বর ওয়ার্ডটি এ বার তপসিলি মহিলা হিসাবে সংরক্ষিত। ওই ওয়ার্ডে উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায়নি বলে দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে। সে কারণেই অন্য ওয়ার্ড থেকে রত্নাদেবীকে নিয়ে গিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে। ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিল তাঁর, জানালেন প্রার্থী। তবে সুযোগ এ বারই প্রথম এল।
কেন ভোটে দাঁড়ালেন? প্রার্থীর কথায়, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। মনের মধ্যে সুপ্ত বাসনা ছিল, ভোটে দাঁড়িয়ে কাউন্সিলর হতে পারলে আরও বেশি করে মানুষের পাশে থাকতে পারব। সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত। তৃণমূল নেতা শঙ্কর দত্ত যখন আমাকে ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিলেন, তখন দু’বার আর ভেবে দেখিনি।’’ কলেজ জীবনে রাজনীতি করেছেন রত্নাদেবী। স্বামী গৌতম বিশ্বাস স্কুল শিক্ষক। তিনিও ভোটে দাঁড়াতে উৎসাহ দিয়েছেন। প্রার্থী জানালেন, মেয়েরা যেমন সংসারের হাল ধরতে পারেন, তেমনি ভোটে দাঁড়িয়ে মহিলারা এলাকার উন্নয়নও করতে পারেন। তাঁর কথায়, ‘‘ওয়ার্ডের সব এলাকায় পানীয় জলের লাইন নেই। কাউন্সিলর হলে প্রথমেই বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব।’’
৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে শাসক দলের প্রার্থী হয়েছেন বছর একত্রিশের ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায় কর। ঝুমাদেবীর স্বামী আশিস ওই ওয়ার্ডের তৃণমূলের সভাপতি। প্রার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। তিনি কখনও হাতেকলমে রাজনীতি করেননি। কেন ভোটে দাঁড়ালেন?
ঝুমাদেবীর কথায়, ‘‘ওয়ার্ড থেকে আমার স্বামীর ভোটে দাঁড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু আসনটি সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় স্বামীর ইচ্ছাতেই ভোটে দাঁড়িয়েছি।’’ ঝুমাদেবী এলাকায় খুবই পরিচিত মুখ। প্রার্থী মনে করেন, ‘‘মহিলারা ভোটে দাঁড়িয়ে জন প্রতিনিধি হলে মহিলাদের সমস্যা আরও বেশি করে বুঝতে পারবেন।’’
৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তৃণমূলের এ বার নতুন মুখের প্রার্থী এলাকার প্রভাবশালী নেতা শঙ্কর দত্তের স্ত্রী বুলি দত্ত। শঙ্করবাবু নিজেও ৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। সম্পূর্ণ রাজনীতির পরিবার। বছর চল্লিশের বুলিদেবীর বাপের বাড়িতে রাজনীতির তেমন চল ছিল না। শ্বশুরবাড়িতে এসেই রাজনীতির আবহে ঢুকে পড়েছেন। কেন ভোটে দাঁড়ালেন? বুলিদেবীর কথায়, ‘‘দলকে ভালবাসি। তা ছাড়া, ওয়ার্ডের কর্মীদের প্রবল চাপ ছিল। সে কারণেই দাঁড়াতে হয়েছে।’’ পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে তিনি সচেষ্ট হবেন বলে জানালেন।
৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সিপিএমের হয়ে প্রথম বার ভোটে দাঁড়িয়েছেন বছর পঞ্চাশের শুভ্রা ঘোষ। তিনি পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির গোবরডাঙা আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক। বহু বছর ধরেই সক্রিয় ভাবে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনীতির পরিবেশেই বড় হয়েছেন। দাদা বনগাঁ প্রাক্তন বিধায়ক তথা বর্তমানে দলের বনগাঁ-বাগদা জোনাল কমিটির সম্পাদক পঙ্কজ ঘোষ। ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছে শুভ্রাদেবীর বহু দিন থেকেই ছিল। কিন্তু সে ভাবে সুযোগ আসেনি। এ বার দলের প্রস্তাব পেয়ে আর না করেন নি। কেন ভোটে দাঁড়ালেন? শুভ্রাদেবীর জবাব তুলনায় বেশ পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদের মতোই। বললেন, ‘‘পুর ভোটে দাঁড়িয়েছি, কারণ এলাকার মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর করতে চাই। পুরসভার স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত করতে চাই। আর ঘরে ঘরে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে চাই। সর্বোপরি, দল ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। তা মেনে নিয়েছি।’’
উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক বছর একান্নোর সুব্রত বিশ্বাস ভোটে দাঁড়িয়েছেন ১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে। ছাত্র জীবন থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তিনি ভোটে দাঁড়িয়েছেন। এখন ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চলছে প্রার্থী পরিচিতি পর্ব। কেন ভোটে দাঁড়ালেন? সুব্রতবাবুর কথায়, ‘‘এখন রাজনীতিতে যে দুবৃর্ত্তায়ন ও দুনীর্তি চলছে, তা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে চাই। শিক্ষিত মানুষ যত ভোটে দাঁড়াবেন, ততই সেই কাজ সম্ভব হবে।’’
চাষবাস করেন বছর সাঁইত্রিশের বিশ্বনাথ বিশ্বাস। ১০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সিপিএমের হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। স্নাতকস্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বছর কুড়ি ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে ওয়ার্ডে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভোটে দাঁড়ানোর কারণ হিসাবে প্রার্থী জানালেন, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আরও ভাল কাজ করতে চান।
১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বিজেপির প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন বছর বিয়াল্লিশের গৌতম পাল। পেশায় ব্যবসায়ী। লোকসভা নির্বাচন থেকে বিজেপি করছেন। অতীতে কংগ্রেস ও পরে তৃণমূল করছেন। ওয়ার্ডের মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয়। কেন ভোটে দাঁড়িয়েছেন? গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘ওয়ার্ডের মানুষ আমাকে খুবই ভালোবাসেন বলে জানি। বাস্তবে তাঁরা কতটা আমাকে পছন্দ করেন, তা বুঝতেই ভোটে দাঁড়িয়েছি। তা ছাড়া, ওয়ার্ডে কোনও উন্নয়ন হয়নি। ওয়ার্ডের সংখ্যালঘুদের দিকে পুর কর্তৃপক্ষ লক্ষ্য দেননি। তার প্রতিবাদেও এই সিদ্ধান্ত।