ভেলায় চেপে দুর্গত মানুষের অভাব-অভিযোগ শুনছেন ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লা। জীবনতলার সারেঙ্গাবাদ, দেউলির জলমগ্ন এলাকায়। ছবি: সামসুল হুদা।
গত কয়েক দিন আগের টানা বৃষ্টিতে এখনও জলমগ্ন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। এর মধ্যে আবার নতুন করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মঙ্গলবার থেকে বৃষ্টি শুরু হলেও বুধবার সকাল থেকে তা প্রবল আকার নিয়েছে। এর ফলে ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ, সাগর, পাথরপ্রতিমা, ক্যানিং ১, ২, ভাঙড়-২ সহ জেলার ১০টি ব্লক এবং বারুইপুর, রাজপুর-সোনারপুর দু’টি পুরসভা এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। পাশাপাশি বুধবার বিকেলে ঘোড়ামারা দ্বীপে মিনি টর্নেডোয় উড়ে গেল বাড়ির চাল। পুকুরের জল ঘুরতে ঘুরতে ছিটকে পড়ে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ হুগলি নদী-লাগোয়া দ্বীপের রায়পাড়া গ্রামে টনের্ডো দেখা যায়। দেবাশিস পালের বাড়ির টালির চাল উড়ে যায়। একটি পুকুরের মাছও নষ্ট হয়েছে।
এদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হয় ডায়মন্ড হারবার, ক্যানিং ১, ২, ভাঙড় ১, ২ ব্লক এলাকায়। জেলাশাসক পি উলগানাথন সকালেই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ডায়মন্ড হারবারে যান। সেখানে মহকুমাশাসকের দফতরে এনডিআরএফ, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর-সহ বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে বৈঠক করেন। ডায়মন্ড হারবারের বিভিন্ন নদীবাঁধের পরিস্থিতিও খতিয়ে দেখেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ৪৫,৮২৩ জনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। জেলায় এখনও পর্যন্ত ১৫৩টি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। ওই সব ত্রাণশিবিরে এখনও পর্যন্ত ৩৭,৮২১ জন মানুষকে রাখা হয়েছে। জেলায় ১৬১টি ‘কমিউনিটি কিচেন’ খোলা হয়েছে। জেলায় এখনও পর্যন্ত ৯৬টি মাটির বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। ১,৫৫৬টি মাটির বাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে। জেলার ৪৬,৩৪৪ হেক্টর জমির আমন ধান জলের তলায় ডুবে গিয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। এর ফলে ১,৭৯,৬১৭ জন চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১,৫৯৩ হেক্টর জমির আনাজ জলের তলায় ডুবে গিয়েছে। জেলায় নতুন করে ১,৫৮৮ হেক্টর পুকুর ও ভেড়ির মাছ ভেসে গিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন মাছের ক্ষতি হয়েছে। ১১,৫৮২ জন মৎস্যচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ডায়মন্ড হারবার-সহ বেশ কিছু এলাকায় নদীবাঁধে ধস নেমেছে। দুর্গতদের জন্য এখনও পর্যন্ত ৪৩,২১২টি ত্রিপল বিতরণ করা হয়েছে। ৮২.৭৮ মেট্রিক টন চাল বিতরণ হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলা টিম, এনডিআরএফ, এসডিআরএফ টিম বকখালি, ডায়মন্ড হারবার, সাগর, ঘোড়ামারা, গোসাবা ও মৌসুনি দ্বীপে পাঠানো হয়েছে।
এমনিতেই সপ্তাহখানেক আগের বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল ক্যানিং পূর্ব বিধানসভার বিস্তীর্ণ এলাকা। সেই জল এখনও বের হয়নি। ফের বৃষ্টিতে ক্যানিং ২ ব্লকের সারেঙ্গাবাদ, দেউলি ১, ২ ব্লক এলাকা নতুন করে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। কালীতলা থেকে ঢুঁড়ি, বেদেমারি থেকে জীবনতলা-সহ ব্লকের বিভিন্ন রাস্তা জলের তলায় ডুবে থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমস্যা হচ্ছে।
গত কয়েকদিন ধরে ব্লক এলাকা জলমগ্ন থাকায় বহু মানুষ জলবাহিত রোগের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। জীবনতলার বামুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে স্বাস্থ্যশিবিরের আয়োজন করা হয়। ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লা বুধবার সকালে ভেলায় চেপে সারেঙ্গাবাদ, দেউলির জলমগ্ন এলাকা ঘুরে দেখেন। দুর্গত মানুষকে সাহায্যের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করেন।
শওকত বলেন, ‘‘এর আগে কখনও এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখিনি। আমার ব্লক এলাকার মাছ চাষ, ধান, আনাজ চাষ সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমি সমস্ত পরিস্থিতির কথা জেলা, রাজ্য নেতৃত্ব-সহ জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।’’
ঘোড়ামারা পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্জীব সাগর বলেন, ‘‘বৃষ্টির জন্য বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। তা সারানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’ নদীবাঁধে ভাঙন নিয়ে সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা বলেন, ‘‘টানা বৃষ্টির জেরে ঘোড়ামারা ও মৌসুনির জি প্লটে কয়েকটি স্পটে নদীবাঁধে ধস নেমেছে। বৃষ্টি কমলে সেচ দফতর থেকে তা সারানোর ব্যবস্থা করা হবে।’’
জেলাশাসক পি উলগানাথন বলেন, ‘‘নতুন করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ফের বহু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। যদি বৃষ্টির পরিমাণ আরও বাড়ে, তা হলে সমস্যা তৈরি হতে পারে। আমরা পরিস্থিতির উপরে নজর রেখেছি। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় সব রকম পদক্ষেপ করেছি। বহু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে এসেছি।’’
উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি এলাকায় ঝড়বৃষ্টি অবশ্য তেমন হয়নি বুধবার সকাল থেকে। মাঝে মধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছে। হিঙ্গলগঞ্জের বিডিও শাশ্বতপ্রকাশ লাহিড়ী বলেন, ‘‘ব্লকের কোথাও ঝড়-বৃষ্টি তেমন কিছু হয়নি।’’ সন্দেশখালি ১ বিডিও সুপ্রতিম আচার্য বলেন, ‘‘বাঁধে কোথাও নতুন করে সমস্যা কিছু হয়নি।’’