সমস্যায় সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা। —নিজস্ব চিত্র।
কিছু দিন আগে মাত্র এক দিনের ব্যবধানে সুন্দরবনের নেতিধোপানি বিট অফিস লাগোয়া পিরখালির জঙ্গলে দু’টি বাঘের হামলার ঘটনা ঘটে। মৃত্যু হয় সুশান্ত প্রামাণিক নামে এক মৎস্যজীবীর। পর দিন মৃত্যুঞ্জয় সুতার নামে আর এক মৎস্যজীবীকে তুলে নিয়ে যায় বাঘ। একই এলাকায় এমন দুর্ঘটনার পরে সেখানে মাছ-কাঁকড়া ধরতে মৎস্যজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে বন দফতর। বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। জঙ্গল লাগোয়া খাঁড়িতে প্রবেশ করেও বহু মৎস্যজীবীর প্রাণহানি হয়েছে আগে। তা রোধ করেতেই এই পদক্ষেপ বলে জানিয়েছে বন দফতর। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর জোন্স জাস্টিন বলেন, “একই এলাকায় দু’টি দুর্ঘটনার পরে আমাদের অনুমান, শিকারের লোভে বাঘ ফের ওখানে আসবে। ফলে সেখানে মাছ ধরা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছি, টহলদারিও বাড়ানো হয়েছে।”
এ দিকে, সুন্দরবনের জঙ্গল লাগোয়া নদী-খাঁড়িতে মাছ ধরার জন্য নতুন অনুমতিপত্র বা বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) দেওয়া হচ্ছে না বন দফতরের তরফ থেকে। বহু বছর ধরেই এই পরিস্থিতি। ফলে নতুন যাঁরা এই পেশায় আসছেন, তাঁদের অনুমতিপত্র ছাড়াই জলযান নিয়ে মাছ-কাঁকড়া ধরতে যেতে হচ্ছে। বাঘের হামলার মুখেও পড়ছেন অনেকে। প্রাণ হারালে মিলছে না ক্ষতিপূরণ। সুশান্ত বা মৃত্যঞ্জয়ের পরিবারও কোনও সাহায্য পাবেন কি না, রয়েছে সংশয়। এই পরিস্থিতিতে নতুন করে অনুমতিপত্রের দাবিতে সরব হয়েছে মৎস্যজীবী সংগঠনগুলি।
বন দফতর সূত্রের খবর, ১৯৭৩ সালে শেষ বার ৮৫০টি অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যেই প্রায় ২৭০টি বিএলসি বাতিল হয়েছে বিভিন্ন কারণে। এখন ৫৭৬টি বিএলসি চালু রয়েছে। অভিযোগ, যাঁদের নামে এই অনুমতিপত্র, তাঁরা আর মাছ ধরার পেশায় যুক্তই নন। নিজেদের নামের বিএলসি বছরে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকায় ভাড়ায় খাটাচ্ছেন তাঁরা। এই বিপুল পরিমাণ টাকায় বিএলসি ভাড়া নেওয়া মানুষেরা বাড়তি রোজগারের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েও জঙ্গলের অভ্যন্তরে যাচ্ছেন। বিপদেও পড়ছেন অনেক সময়ে।
অন্য দিকে, ‘প্রকৃত মৎস্যজীবী’ অনেকে বন দফতরের অনুমতিপত্র ছাড়া জঙ্গলে ঢুকে বন দফতরের হাতে ধরা পড়ছেন। মোটা টাকা জরিমানা দিতে হচ্ছে, নৌকো, সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করছে বন দফতর। এমন মৎস্যজীবীরাই মূলত সরব হয়েছেন অনুমতিপত্রের দাবিতে। বিভিন্ন মৎস্যজীবী সংগঠনের তরফে আন্দোলন চলছে। যৌথ বনপরিচালন কমিটি ও এলাকার মৎস্যজীবীরাও আবেদন করেছেন বন দফতরের কাছে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাটেড ফিশারমেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জয়কৃষ্ণ হালদার বলেন, “দীর্ঘ দিনের এই সমস্যার জেরে সুন্দরবনের প্রকৃত মৎস্যজীবীরা বঞ্চিত। বন দফতর প্রকৃত মৎস্যজীবীদের বিএলসি দিচ্ছে না। এ দিকে, এঁরা বিপদে পড়লে ক্ষতিপূরণও পাচ্ছেন না। মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়ে হেনস্থা হচ্ছেন। আমরা এ নিয়ে আন্দোলন করে চলেছি।”
গোসাবার জেলা পরিষদের সদস্য তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের উপাধ্যক্ষ অনিমেষ মণ্ডল বলেন, “আমরা ২০১৮ সাল থেকে বন দফতরের কাছে লাগাতার আবেদন করছি, প্রকৃত মৎস্যজীবীদের বিএলসি দেওয়ার দাবিতে। কিন্তু কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এ দিকে, যাঁদের নামে বিএলসি রয়েছে, তাঁদের ৯০ শতাংশই এই পেশায় আর যুক্ত নন। মোটা টাকার বিনিময়ে তাঁরা নিজেদের বিএলসি ভাড়া খাটাচ্ছেন।” দয়াপুর যৌথ বন পরিচালন কমিটির সদস্য চিত্তরঞ্জন রায়ের কথায়, “সুন্দরবনের নদী-খাঁড়িতে মাছ-কাঁকড়া ধরাই আমাদের জীবিকা। কিন্তু বন দফতরের অনুমতিপত্র নেই আমাদের কাছে। ফলে বিপদে পড়লেও সাহায্য পাব না। আমাদের দাবি, বন দফতর সঠিক তদন্ত করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের এই শংসাপত্র দিক।”
জোন্স জাস্টিন বলেন, “মৎস্যজীবীদের এই অভিযোগ বা দাবি অমূলক নয়। এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবে এখনও কোনও নির্দেশিকা আসেনি।”