ক্যানিংয়ে নদীর চরে বসানো হচ্ছে ম্যানগ্রোভ। ফাইল চিত্র।
শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, অরণ্য কেটে মাছের ভেড়ি তৈরি এবং বেলাগাম বনসম্পদ পাচারে বিপন্নতা বেড়েছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের। এমনটাই দাবি সুন্দরবনবাসীর একাংশের। তাঁদের অভিযোগ, বাণিজ্যিক কারণে অরণ্য ধ্বংস করা এবং পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ না হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে পরিবেশের।
‘ইয়াস’-এর জেরে সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভের বড়সড় ক্ষতি হয়েছে বলে আশঙ্কা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের। উদ্বিগ্ন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। গত বছর আমপানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল অরণ্যের। ক্ষতপূরণে বনসৃজনের উদ্যোগী হয় প্রশাসন। সেই কাজ কতটা হয়েছে তা প্রশাসনিক বৈঠকে জানতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জেলা প্রশাসনের এক কর্তার দাবি, ‘‘সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে পাঁচ কোটি ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছে। ওই কাজ হয়েছে বন দফতরের সহযোগিতায় ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে।’’
অরণ্য ধ্বংস করে মেছোভেড়ি করার অভিযোগ অবশ্য সুন্দরবনে নতুন নয়। এই ধরনের কাজ প্রকাশ্যে এলে প্রশাসন ‘কড়া ব্যবস্থা’ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না বলে অভিযোগ অরণ্যবাসীর। তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রশাসনের আধিকারিকদের একাংশও। তাঁদের এক জন জানান, বাসন্তীর ভরতগড়, আনন্দাবাদ ও ভাঙনখালি এলাকায় ম্যানগ্রোভ গাছ কেটে তৈরি হয়েছে বেআইনি মেছোভেড়ি। রাতে মেশিন দিয়ে গাছ কাটা হয়েছে। আদালতে এ নিয়ে মামলা হয়েছে। পরে পুলিশ ও প্রশাসন অনেক বেআইনি মেছোভেড়ি বন্ধ করে দেয়। আটক করে বেশ কিছু যন্ত্র।
তার পরেও থেমে নেই বৃক্ষনিধন, দাবি এলাকাবাসীর একাংশের। সম্প্রতি বাসন্তীর ভরতগড়, আনন্দাবাদ, ভাঙনখালি, কুলতলী, মৈপীঠ, ঠাকুরণ, বনি ক্যাম্প, ভুবনেশ্বরী ও মাতলা নদীর চরে ম্যানগ্রোভ কেটে বেআইনি ভাবে মেছোভেড়ি তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ। অনেক জায়গায় গাছ কেটে কাট ইটভাটায় সরবরাহ করা হয়েছে। অনেক জায়গায় আবার অরণ্য কেটে বসতি গড়ে উঠেছে।
ডিএফও (দক্ষিণ ২৪ পরগনা) মিলনকান্তি মণ্ডলের দাবি, ‘‘জেলার বিভিন্ন ব্লক মিলিয়ে ৫ কোটি ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছে। তার ছবি-সহ তথ্যপ্রমাণ আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছি।’’ বিরোধীরা অবশ্য এই দাবি মানতে নারাজ। সুন্দরবনের ‘ভূমিপুত্র’ বলে পরিচিত সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘আমার বাড়ি সুন্দরবনের নদী তীরবর্তী এলাকায়। কোথাও ম্যানগ্রোভের ছিটেফোঁটাও লাগানো হয়নি। সবটাই স্রেফ প্রচার। প্রতিনিয়ত ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা হচ্ছে। মানুষ যেমন সচেতন নন, তেমন প্রশাসনও নির্বিকার। আমি একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’’
একই অভিযোগ প্রাক্তন সেচমন্ত্রী আরএসপি নেতা সুভাষ নস্করের। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও সুন্দরবনে কোথাও ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানো হয়নি। উল্টে অরণ্য ধ্বংস করে তৈরি হয়েছে মেছোভেড়ি। এই কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেটা করা গেলে ইয়াস-এর মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা যেত। কিন্তু তা করা যায়নি। এটা সরকার-সৃষ্ট বিপর্যয়।’’ কী বলছে সরকার? সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী বঙ্কিম হাজরার প্রতিক্রিয়া, ‘‘সবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। ঠিক কী হয়েছে তা এখনই বলতে পারব না। তবে এ রকম কোনও অভিযোগ থাকলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’’ ডিএফও-র দাবি, ‘‘জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখছে। যেখানে ম্যানগ্রোভ নষ্ট হয়েছে, সেই সমস্ত জায়গায় আবার নতুন করে গাছ লাগানো হবে। আগামী তিন বছরের জন্য রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ধরা আছে।’’পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘১৯৯১ কোস্টাল রেগুলেশন আইন
অনুযায়ী নদী তীরবর্তী এলাকায় হোটেল ও রিসর্ট তৈরি নিষিদ্ধ। কিন্তু তা মানা হয়নি।’’