কাউনসিলর অনুপম দত্ত।
বুধবার পানিহাটি পুরসভার নব নির্বাচিত কাউন্সিলরেরা শপথ নেবেন। বোর্ড গড়বে শাসকদল। কিন্তু সেখানে বাদ থাকবেন তৃণমূলেরই এক কাউন্সিলর। তিনি অনুপম দত্ত। গত ১৩ মার্চ নিজের এলাকাতেই দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়েছেন।
গুলি যে চালিয়েছিল, সেই যুবক-সহ মূল অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়েছে। এখনও তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু মঙ্গলবার সারা দিন ধরে পানিহাটির আট নম্বর ওয়ার্ড, অর্থাৎ অনুপমের নিজের এলাকা ছিল থমথমে। মোড়ে মোড়ে চলেছে জটলা। স্থানীয়দের পাশাপাশি কাউন্সিলরদেরও বক্তব্য, তাঁরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না ঘটনাটি। আবার অনুপমের ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলরেরা জানালেন, তাঁকে ছাড়া যে শপথ নিতে হবে, ভাবতেই পারছেন না তাঁরা। তাই অনাড়ম্বর শপথের পথেই আজ হাঁটবে পানিহাটি পুরসভা।
সোমবার দুপুরে কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ মর্গে যখন অনুপমের দেহের ময়না-তদন্ত চলছিল, সেই সময়ে বাইরে উপস্থিত থাকা সতীর্থদের অনেকেরই আক্ষেপ, ‘‘ওঁর মতো ছেলের এমন হল! এর পরে তো রাজনীতি করতেই আতঙ্ক হচ্ছে।’’ ঘটনাটি পুরোপুরি অনভিপ্রেত বলে জানিয়ে পানিহাটির গত বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মলয় রায় বললেন, ‘‘এক জন কাউন্সিলরকে এ ভাবে এলাকায় ঢুকে খুন করা হল। যত ক্ষণ না পুলিশ গোটা রহস্যের উদ্ঘাটন করতে পারছে, তত ক্ষণ তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু কাউন্সিলর হিসেবে যখন নির্বাচিত হয়েছি, মানুষ ও এলাকার স্বার্থে তো কাজ করতেই হবে।’’
সতীর্থের মৃত্যু এখনও মেনে নিতে পারছেন না আর এক তৃণমূল কাউন্সিলর সোমনাথ দে। তাঁর কথায়, ‘‘অনুপমকে এ ভাবে খুন হতে হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। তাই কোনও আড়ম্বর নয়। সরকারি নিয়ম মেনে যেটুকু দরকার, সেটা করেই সকলে শপথ নেব।’’ পানিহাটির ৩৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে একটিতে কংগ্রেস ও একটিতে সিপিএম জিতেছে। বাকি ৩৩টি ওয়ার্ড ছিল শাসকদলের দখলে। অনুপমের মৃত্যুর পরে হিসেব মতো আজ শপথ নেবেন ৩৪ জন কাউন্সিলর। শাসক দলের কাউন্সিলরেরা জানাচ্ছেন, গত ২ মার্চ
পুরভোটের ফল প্রকাশের পরে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে অনুপম লিখেছিলেন, ‘এর পরে আর কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু এটুকুই বলব, যে ঋণের বোঝা মাথায় চাপিয়ে দিয়েছেন আট নম্বর ওয়ার্ডের মানুষেরা, তা পরিবারের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করব’।
স্বামীর স্বপ্ন তিনি কখনও শেষ হতে দেবেন না বলে এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন অনুপমের স্ত্রী মীনাক্ষী দত্ত। কোনও মতে চোখের জল সামলে নিয়ে বললেন, ‘‘স্বামীর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিচ্ছি আমি। ওয়ার্ডের মধ্যেই ওরা অনুপমকে খুন করল। যারা এই ঘটনায় জড়িত, তাদের কঠোর শাস্তি চাই। ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে, বুঝতে পারছি না। তবে এই আট নম্বর ওয়ার্ড থেকেই আমি লড়াই শুরু করতে চাই।’’
মায়ের মতো এ দিনও ক্রমাগত কেঁদে চলেছে অনুপমের সাত বছরের ছেলে উৎসব ও ১৩ বছরের মেয়ে অনুষ্কা। মোবাইল থেকে বাবার ছবি বার করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে দিদি-ভাই। কাঁদতে কাঁদতে অনুষ্কা বলল, ‘‘আমার বাবাকে ওরা কেড়ে নিল। আমার গায়ে হাত বুলিয়ে কে আর আদর করবে? কার কাছে সব আবদার করব?’’ গত ১৩ মার্চ, রবিবার দুপুরে বাবার সঙ্গে অনুষ্কাও গিয়েছিল কুকুরছানা আনতে। বাড়িতে নিয়ে এসে মা ও ভাইকে ‘সারপ্রাইজ়’ দিয়েছিল।
এ দিনও মীনাক্ষী যখন খুব বেশি ভেঙে পড়ছিলেন, তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছে অনুষ্কা। বলেছে, ‘‘তুমি কেঁদো না মা। বাবা কষ্ট পাবে তো।’’ আর ‘‘পাপা কখন আসবে’’ প্রশ্ন তুলে মাঝেমধ্যেই মোবাইলে অনুপমের ছবিতে হাত বুলিয়েছে ছোট্ট উৎসব। পুরভোটে জয়ের পরে
এ দিন সন্ধ্যায় বিজয় মিছিল হওয়ার কথা ছিল আট নম্বর ওয়ার্ডে। পূর্ব ঘোষণা মতো এ দিন সন্ধ্যায় মিছিল হল ঠিকই, তবে তা অনুপমের স্মরণে মোমবাতি মিছিল। তাতে হাঁটলেন মীনাক্ষীও।