নিরুপায়: নষ্ট হয়ে যাওয়া কপি মাঠ থেকে তুলে ফেলে দিচ্ছেন চাষিরা। ভাঙড়ে ছবিটি তুলেছেন সামসুল হুদা।
ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ হলেও শীত না পড়ায়, ঘন কুয়াশার জন্য চাষে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ক্যাপসিকাম, লঙ্কা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, আলু-সহ বিভিন্ন ধরনের আনাজের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা।
গত বছর অতিবৃষ্টি আনাজের বেশ ক্ষতি করেছিল। সেই ধাক্কা সামলে উঠে ধারদেনা করে অনেকে শীতকালীন আনাজ চাষ করেছেন। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূল নয় বলে জানাচ্ছেন অনেকেই।
বুধবার ভাঙড় ২ ব্লকের পানাপুকুর, কাঁঠালিয়া, ভুমরু গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, অনেক চাষি মাঠ থেকে ফুলকপি তুলে ফেলে দিচ্ছেন। তাঁদের অভিযোগ, কপির দাম মিলছে না, তার উপরে জাঁকিয়ে শীত না পড়ায় কপিতে পচন ধরছে। নষ্ট হচ্ছে লঙ্কা, ক্যাপসিকামও। ভাইরাসের কারণে মরে যাচ্ছে অনেক গাছ। ফসলে দাগ এসে যাচ্ছে। পাইকারি বাজারে আনাজের বিক্রি কমেছে। পরিস্থিতি এ রকম চললে মহাজনের টাকা মেটাতে পারবেন না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন অনেকে।
পানাপুকুর গ্রামের চাষি আনোয়ার আলি মোল্লা বলেন, “আবহাওয়ার কারণে ফুলকপি ফুটে গিয়েছে। বাজারে নিয়ে গেলে কেউ কিনতে চাইছেন না। বাধ্য হয়ে খেত থেকে তুলে ফেলে দিচ্ছি।” তিনি জানান, গত বছর যে মিক্সচার সারের দাম ছিল ৫০০ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার টাকা। ৫০ কেজি দানা সারের বস্তার দাম ছিল ৮০০ টাকা, এখন তা দু’হাজার টাকা। ফলন ভাল না হলে মহাজনের ঋণের টাকা শোধ করা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তিনি।
ব্লক কৃষি দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, শীতের অভাবে ও ভাইরাসের কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে চাষিদের এক গ্রাম বোরন (অনুখাদ্য) প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করার কথা বলা হচ্ছে। গাছের পাতা শুকিয়ে গেলে, দাগ দেখা দিলে ম্যানকোজ়েব ও মেটালাক্সিল (ছত্রাকনাশক) মিশ্রণ করে স্প্রে করতে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি, জৈব সারের সঙ্গে এক কেজি জৈব জীবাণুনাশক লাইকোডার্মা ভ্রিডি প্রয়োগ করলে ফসলের উন্নতি হবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। এখন অনেক হাইব্রিড বীজ এসেছে বাজারে। সেগুলি যে কোনও আবহাওয়া ও প্রতিকূল পরিবেশে সঠিক ফলন দেয় বলে জানালেন তাঁরা।
জেলা হর্টিকালচার দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় প্রায় সাত হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন আনাজের চাষ হয়। এর মধ্যে ভাঙড় ১ ব্লকে ২২৫০ হেক্টর জমিতে ও ভাঙড় ২ ব্লক এলাকায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন আনাজ চাষ হয়। বিশেষ করে ভাঙড়ের ওই দুই ব্লকের চন্দনেশ্বর, বোদরা, নারায়ণপুর, পানাপুকুর, ভুমরু, চিলেতলা, কাঁঠালিয়া, পোলেরহাট-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় আনাজ চাষ হয়। রাজ্যের আনাজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভাঙড় অন্যতম। শুধু তাই নয়, ভাঙড়ের আনাজ বিদেশেও রফতানি করা হয়।
জেলার হর্টিকালচার দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, “এটা ঠিক যে, এ বছর শীতের অভাবে শীতকালীন আনাজ চাষে ক্ষতি হয়েছে। তবে এবার কপির ফলনও প্রয়োজন অতিরিক্ত হওয়ায় চাষিরা দাম পাচ্ছেন না। আনাজের ক্ষতি এড়াতে চাষিরা আমাদের দফতরের পরামর্শ অনুযায়ী কোন জাতের বীজ লাগাতে হবে, তা ঠিক করতে পারেন। আমরা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছি।”
শীতের আমেজ না থাকায় শশা, বেগুন, ফুলকপি, লঙ্কা চাষে ক্ষতির মুখে পড়ছেন হিঙ্গলগঞ্জের চাষিরা। হিঙ্গলগঞ্জের বায়লানির কৃষক পার্থসারথি বর, দীনবন্ধু সর্দার জানান, শশা চাষের খুবই ক্ষতি হচ্ছে। ফুল হয়েছে, ফল হচ্ছে না। সেই সঙ্গে ফুলকপির ফুল বড় হচ্ছে না। সাধারণত ১৫-৩০ দিনের মধ্যে ফুলকপি বড় হয়ে যায়, কিন্তু শীত না থাকায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও ফুলকপি বড় হচ্ছে না। পার্থসারথি জানান, এখন তাঁদের থেকে ফুলকপি কেনা হয় এক টাকা কেজি দরে। দীনবন্ধুর কথায়, লঙ্কা চাষে সব থেকে বেশি সমস্যা হচ্ছে। সাদা পোকা লাগছে গাছে। গত ১৫ তারিখ থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে এক কাঠা জমি পিছু আনাজ চাষে প্রায় ২০০ টাকা করে খরচ হচ্ছে সার-তেল পিছু। সব ঠিক থাকলে শীতের আনাজ উৎপাদনও ভাল হত, বাড়তি খরচও হত না।