দেগঙ্গায় কেটে ফেলা হচ্ছে পাট। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।
অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় কারণে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন বসিরহাট ও দেগঙ্গার কৃষকেরা। বিশেষ করে সুন্দরবন লাগোয়া জমিতে চাষ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারি ভাবে ইতিমধ্যে বীজ ধান দেওয়ার পরিকল্পনা করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে অভিযোগ চাষিদের। শুধু তাই নয়, নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় জমি ডুবে রয়েছে। এর ফলে ওই বীজ কাজে লাগছে না বলেও জানিয়েছেন চাষিরা। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভ্রূকুটি তাঁদের মধ্যে আরও আতঙ্ক তৈরি করেছে।
প্রশাসন এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, টানা বৃষ্টিতে মহকুমার ১০টি ব্লকের একটি বড় অংশে সব্জি, ধানের জমি বর্তমানে একহাঁটু জলের তলায়। সুন্দরবন এলাকায় স্লুইস গেট খারাপ হওয়ার কারণে জল নিকাশি ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে যে সব কৃষকের উঁচু জমিতে ভিটে বাড়ি আছে, তাঁরা সেখানে বীজতলা তৈরি করেছেন। কিন্তু জমি থেকে জল না সরায় তা রোপণ করতে পারছেন না। হিঙ্গলগঞ্জের সাহেবখালির অঞ্জন মণ্ডল, গুণধর মিস্ত্রি বলেন, ‘‘ইতিমধ্যে কেউ দু’বার, কেউ তিনবার করে বীজধান রোপণ করলেও বৃষ্টি এবং কালিন্দী নদীর স্লুইস গেট খারাপের কারণে একহাঁটু করে জমিতে জল জমে রয়েছে। এখানে বছরে এক বার ধান হয়। কিন্তু এ বার যা অবস্থা, এখনও বীজধান রোপণ করতে পারিনি।’’
মহকুমা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ১০টি ব্লকের ৫৫৮টি মৌজার মধ্যে বৃষ্টির ফলে ১৯০টি মৌজার বীজ ধান ও সব্জি ক্ষতি হয়েছে। সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবন লাগোয়া হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি ১ ও ২ ব্লক। হিঙ্গলগঞ্জে ১৩০০ হেক্টরের মধ্যে ৯২২ হেক্টর, সন্দেশখালি ১ ব্লকে ৮০৮ হেক্টরের মধ্যে ৭০৮ হেক্টর ও সন্দেশখালি ২ ব্লকে ১০০০ হেক্টরের মধ্যে ৮০০ হেক্টর জমির বীজতলা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। একই রকম ভাবে ক্ষতি হয়েছে মিনাখাঁ, বাদুড়িয়া, স্বরূপনগরেও বীজধান নষ্ট হয়েছে। তবে একটু অন্যরকম পরিস্থিতি বসিরহাট ১ ও ২ ব্লকে, হাড়োয়া, হাসনাবাদে। বসিরহাটের দু’টি ব্লকে ১২৯২ হেক্টরের মধ্যে ৩৯০ হেক্টর, হাড়োয়ায় ২৭৭ হেক্টরের মধ্যে ১৪৫ হেক্টর ও হাসনাবাদ ব্লকে ৮৫ হেক্টরের মধ্যে ৩৮ হেক্টর জমিতে জমা জল কিছুটা বের করে দেওয়া সম্ভব হওয়ায় বর্তমানে অবস্থা খানিকটা উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ধানের পাশাপাশি পটল, ওল, ঝিঙে, উচ্ছে, লঙ্কার মতো সব্জি চাষ ক্ষতি হয়েছে। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, বসিরহাট মহকুমায় ৩ হাজার ৪৭৮ হেক্টর জমিতে সব্জি চাষ হয়েছিল। অতি বৃষ্টির কারণে মারাত্মক ভাবে ক্ষতি হয়েছে ৯৮৫ হেক্টর এবং আংশিক ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ২০৭ হেক্টর জমির ফসল।
গাইঘাটায় এখনও জলমগ্ন বহু এলাকা।
মহকুমাশাসক শেখর সেন বলেন, ‘‘ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা যাতে সরকারি ভাবে ধানের বীজ পান সে ব্যাপারে কৃষি দফতরকে বলা হয়েছে। মহকুমায় ৬৯টি স্লুইস গেট দ্রুত মেরামতির জন্য সেচ দফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ মহকুমা কৃষি আধিকারিক শঙ্কর দাস বলেন, ‘‘বৃষ্টিতে নিচু জমিতে জল দাঁড়িয়ে যাওয়ার কারণে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় এক ফসলি জমিতে বিজ ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে এই মহকুমার কয়েক লক্ষ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে মহকুমার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য ১৬১-৯১ মেট্রিক টন সর্না মাসুল, এমটিইউ ১০১০, গোঠরা বিধান-১, সি আর ১০১৭ বীজ ধান বিলি শুরু হয়েছে। আরও ‘সিড কিটের’ ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’
দেগঙ্গাতেও ধান-সব্জির ক্ষতি হয়েছে। দেগঙ্গা কৃষি দফতরের দাবি, ইতিমধ্যে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা গত কুড়ি বছরের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। কমল মণ্ডল, খালেক গাজি, রূপেন বিশ্বাসরা বলেন, ‘‘যেখানে অন্য বার ১০ টনের উপর ওল ফলত, সেখানে এ বার জল জমার কারণে ৪ টনের বেশি ওল পাওয়া সম্ভব নয়।’’ অভিযোগ উঠেছে, এক দিকে যেমন বিভিন্ন নদীর স্লুইস গেট খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে, তেমনি প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে বহু এলাকায় নিকাশি নালা বন্ধ করে এক শ্রেণির মানুষ দোকান, বাড়ি করেছেন। এলাকায় বিদ্যাধরী ও পদ্মা নদী থাকা সত্ত্বেও বেহাল নিকাশির জন্য জমির জল সরতে চাইছে না। দেগঙ্গা ব্লক কৃষি আধিকারিক দীপক বিশ্বাস বলেন, ‘‘জমির শ্রেণির উপরে নির্ভর করে ৯৫-১১০ দিনের মধ্যে অন্নদা, এমটিইউ ১০১০, গোটরা-সহ কিছু প্রজাতির ধান চাষ করলে আগামী শীতের মরসুমে সর্ষে চাষ করা যাবে। সে দিকে লক্ষ্য রেখে বাড়ির উঠোনে প্লাস্টিক পেতে তার উপর জৈব সার মিশ্রিত মাটিতে ২ ইঞ্চি পূরণ করে তার উপরে ধানবীজ তৈরি করা যাবে।’’