বাড়ি বাড়ি বিক্রির জন্য চলেছে জল।—নিজস্ব চিত্র।
ইছামতী নদী দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বহু জল। শহর ঘিরে একাধিক খালও আছে। কিন্তু বসিরহাটের মানুষের আর্সেনিক-মুক্ত পরিস্রুত পানীয় জলের অভাব এখনও ঘুচল না। নিকাশিও বেহাল। একের পর এক ভোট আসে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি যে কে সেই।
১৮৬১ সালের ১ জানুয়ারি ৩৫২ বর্গ মাইল এবং ২ লক্ষ ৬৮ হাজার ১৪৬ জন নাগরিক নিয়ে বসিরহাট মহকুমা গঠিত হয়। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল বাদুড়িয়া, টাকি এবং বসিরহাটে তিনটি পুরসভা গঠন করা হয়। মাত্র ১২,১০৫ জনকে নিয়ে ১০টি ওয়ার্ডের বসিরহাট পুরসভা ২০১৫ সালে পৌঁছেছে ২৩টি ওয়ার্ডে।
পুরভোট আসন্ন। বসিরহাট পুর এলাকার উন্নয়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি যতই গলা ফাটাক না কেন, বাস্তব বলছে অন্য কথা। পুর এলাকার একটা বড় অংশে এখনও পানীয় জলের কলের দেখা মেলে না। আর যদিও বা দু’চারটে টাইম কল আছে, তা-ও হয় অকেজো, না হয় এত সরু জল পড়ে যে এক কলসি জল ভরতে দীর্ঘ ক্ষণ লেগে যায়। জল ভরতে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রায়ই বাসিন্দাদের মধ্যে হাতাহাতি, চুলোচুলি বাধে।
ত্রিমোহনী এলাকায় মূল রিজার্ভার থেকে ইটিন্ডা রাস্তার নীচ দিয়ে আসা ব্রিটিশ আমলে পোঁতা জলের পাইপ প্রায়ই ফেটে যায়। এর ফলে ওই ফাটা জায়গা দিয়ে নোংরা ঢুকে পানীয় জলের সঙ্গে মিশে যায়। সেই জলই বাধ্য হয়ে খেতে হয় শহরবাসীকে।
বসিরহাট শহরে হাতকলের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। ভেঙে পড়েছে টাইমকল পরিষেবা। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি গভীর নলকূপের অবস্থাও তথৈবচ।
রতন পরামানিক, সব্যসাচী চক্রবর্তী, মলিনা মণ্ডলরা বলেন, “পুর কর্তৃপক্ষ এবং জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের নজরদারির অভাবে প্রয়োজনীয় অনুমতি ছাড়াই রিজার্ভার-বিহীন বহু বাড়িতে পানীয় জলের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। মোটরের মাধ্যমে জল টেনে নেওয়ার কারণে রাস্তার কলে জল পড়ে না। আবার জলের চাপ কম হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে মোটর না চালালে জল ওঠে না।” নলকোড়ার জলে আর্সেনিকের মাত্র তীব্র আকার নিয়েছে বলে অভিযোগ। কেবল পানীয় জলই নয়, অপরিকল্পিত ভাবে শহর গড়ে ওঠা এবং প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পুকুর-ডোবা বন্ধ করায় স্নানের জলেরও তিব্র আকাল দেখা দিয়েছে।
পানীয় জলের মতোই চরম বেহাল জল নিকাশি। পুকুর-নালা বুজিয়ে যত্রতত্র ফ্ল্যাট, বাড়ি, দোকান তৈরি হচ্ছে। মাছের চাষ শুরু হওয়ার জন্য অধিকাংশ জল নিকাশি নালা বন্ধ হয়ে একটু বৃষ্টিতেই সাঁইপালা, পশ্চিম দন্ডিরহাট, এস এন মজুমদার রোড, ভ্যাবলা, পুরাতন বাজার, দাস পাড়া, তপারচর, নলকোড়া, ধলতিথা, ট্যাঁটরা-সহ শহরের বেশির ভাগ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। বসিরহাট ঘিরে আছে ইছামতী নদী, পাথুরিয়া খাল, পিঁফা কাঠাখাল, বদরতলা খাল, চোঙ্গরআটি খাল, তপারচর খাল। তা সত্ত্বেও একটু বৃষ্টি হলেই জল থই থই শহর। বসিরহাট পুরসভার অন্তর্গত নলকোড়া খালপাড় থেকে শুরু করে ধলতিথা বামনপাড়া, বারুইপাড়া এলাকায় নজর করলে দেখা যায়, নিকাশি অবস্থা বেশ খারাপ। আপ্পু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈকত ভট্টাচার্যদের বক্তব্য, “আমাদের এলাকায় প্রধান সমস্যা পানীয় জল। বাড়ির রিজার্ভার না থাকা সত্ত্বেও অনৈতিক ভাবে কিছু কিছু বাড়িতে জলের লাইন দেওয়ায় রাস্তার কলে জল মেলে না।” অন্য দিকে ধলতিথা ব্রাহ্মণপাড়ায় আজও পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে জল মেলে না। অল্প দু’চারটি টাইমকল রাস্তার ধারে থাকলেও অধিকাংশ দিন তাতে জলই আসে না বলে অভিযোগ। তাই বাধ্য হয়েই এলাকার মানুষকে বাজার থেকে জল কিনে খেতে হয় বলে দাবি করলেন খগেন ভট্টাচার্য, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা পাত্ররা। স্থানীয় দাসপাড়ার বাসিন্দাদের দাবি, সেখানে খানা পরিষ্কারই হয় না। পানীয় জল নিয়ে সমস্যা আছে। আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জল চাইলে তা কিনতে হয়।
সমস্যা স্বীকার করলেন বসিরহাট পুরসভার সহকারী বাস্তুকার কাজল হালদার। কাজলবাবুর কথায়, “অধিকাংশ খাল দখল করে পাটা ফেলা, মাছচাষ, বাড়ি-দোকান এবং ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ফলে জল সরবে কোথা দিয়ে।” বসিরহাট পুর এলাকায় ৬০০ হ্যান্ড কল, বারোশোর বেশি ডিপ টিউবয়েল এবং ১০ হাজারের উপর বাড়িতে জলের কানেকশন দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে কাজলবাবু বলেন, “এ সব সত্ত্বেও পানীয় জলের আকাল আছে।” তাঁর মতে, জল নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ, ওয়ার্ড কমিশনারদের ঠিক মতো পরিকল্পনার অভাব। নালা ও খাল পরিষ্কারের অভাবে নদী থাকলেও বর্ষার সময়ে শহরবাসীর একাংশকে প্রতি বছর ভাসতে হয়।
সিপিএম নেতা নিরঞ্জন সাহা বলেন, “আমাদের সময়ে ইছামতী নদীর জল পরিস্রুত করে পানীয় হিসাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস-তৃণমূল পরিচালিত বোর্ড সে বিষয়ে কোনও গুরুত্ব দেয়নি। এটা আমরা প্রচারে তুলে ধরব।”
কংগ্রেস নেতা অমিত মজুমদার বলেন, “পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃণমূল কাউন্সিলরদের ভাঙিয়ে বোর্ড দখল করেছিল। অথচ, কাজের কাজ কিছু হয়নি। এটা আমাদের প্রচারে অন্যতম হাতিয়ার হবে।”
তৃণমূল নেতা দীপেন্দু বিশ্বাস বলেন, “খুব অল্প দিনই আমরা ক্ষমতায় এসেছি। তার মধ্যেই রাস্তাঘাট, পানীয় জল, মোটেল-সহ নানা কয়েক কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে। পরিস্রুত পানীয় জলের জন্য আধুনিকীকরণের উদ্দেশে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পাইপ লাইনের পরিবর্তন করা হবে। এ সব আমরা মানুষের কাছে তুলে ধরব।”
জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী দফতরের বসিরহাটের সহকারী বাস্তুকার জয়দেব মণ্ডল বলেন, “বসিরহাটে ২৬টি বিগ ডায়া টিউবয়েলের সাহায্যে প্রায় ৮০০ শো স্ট্যান্ড পোস্টের মাধ্যমে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
পুরসভা এবং জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী দফতরের সহকারী বাস্তুকারেরা পরিস্রুত পানীয় জলের কলের লম্বা ফিরিস্তি দিলেও কার্যত শহর ঘুরে সেই মাত্রায় কলের চিহ্ন দেখা যায়নি। এতেই যদি পরিস্রুত পানীয় জলের পরিষেবা দেওয়া হবে, তা হলে কেন শহরে প্রায় ৪০টির মতো কারখানা থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার ব্যারেল জল পানীয় হিসাবে বাজারে বিকোচ্ছে, তার উত্তর দিতে পারেননি তাঁরা। বসিরহাটের বিদায়ী পুরপ্রধান অতসী আন বলেন, “পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে পাইপ লাইনের জন্য ৬৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। পুরভোটের পরে কাজ শুরু হবে। তবে মাটির তলা থেকে অবৈধ ভাবে যে বিপুল পরিমাণে জল তোলা হচ্ছে, সে বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখা হচ্ছে।”
কবি ভূজঙ্গধর রোডের বাসিন্দা বসিরহাট হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক চয়ন দেবের কথায়, “এলাকায় ৫টি টাইম কল অকেজো হয়ে পড়েছে। নিকাশি ব্যবস্থার পরিকল্পনার অভাবে এবং নর্দমা জঞ্জালে বুজে যাওয়ায় মশা-মাছির উপদ্রব বাড়ছে। বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। বর্ষাকালে নর্দমা উপচে পড়া জলে শহর ভাসছে।” কমলকান্ত ভৌমিক, অঙ্কুর সেন, কমলা সেন, কাজল দাস, কণিকা মুখোপাধ্যায়, জিয়াউল ইসলাম বলেন, “জলের জন্য বসিরহাটবাসীর অনেককেই পেটের অসুখে ভুগতে হয়। আর এই সুযোগে ওষুধ এবং পানীয় জলের ব্যবসায়ীদের রমরমা।” প্রাক্তন শিক্ষক কালীদাস মজুমদার বলেন, “শতাধিক বছরের পুরানো বসিরহাট পুরসভার শহরে জল নিকাশি এবং পানের উপযুক্ত জল সরবরাহ ব্যবস্থা যথেষ্ট দুর্বল।” দীননাথ দে লেন, উকিলপাড়া, মজুমদার বাগান-সহ টাউনহল-সংলগ্ন এলাকায় তীব্র জল সঙ্কট প্রতি বছরের চিত্র।
(চলবে)