বসিরহাটে ফের বাড়ছে পাচার-অনুপ্রবেশ

মাঝে কিছু দিন বন্ধ থাকলেও মাসখানেক ধরে নতুন করে গরুপাচার এবং অনুপ্রবেশ বাড়ছে বসিরহাট সীমান্তে। পঞ্জাবের পঠানকোট এয়ারবেসে জঙ্গি হামলার পরে যখন দেশের নিরাপত্তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সে সময়ে বসিরহাটের এ হেন ‘উন্মুক্ত’ সীমান্ত যে কোনও মুহূর্তে বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৭
Share:

নজরদারি সত্ত্বেও সমস্যা এড়ানো যাচ্ছে কই? স্বরূপনগরে সোনাই নদীর ধারে ছবিটি তুলেছেন নির্মল বসু।

মাঝে কিছু দিন বন্ধ থাকলেও মাসখানেক ধরে নতুন করে গরুপাচার এবং অনুপ্রবেশ বাড়ছে বসিরহাট সীমান্তে। পঞ্জাবের পঠানকোট এয়ারবেসে জঙ্গি হামলার পরে যখন দেশের নিরাপত্তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সে সময়ে বসিরহাটের এ হেন ‘উন্মুক্ত’ সীমান্ত যে কোনও মুহূর্তে বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা। স্বরূপনগর, হিঙ্গলগঞ্জ বা সন্দেশখালি এলাকায় নদীপথে সুন্দরবনের জঙ্গলকেও কাজে লাগাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। যা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের তেমন হেলদোল নেই বলে অভিযোগ তুলছেন স্থানীয় মানুষজন। পুলিশকর্তাদের দাবি, সীমান্ত এলাকায় নাকাবন্দি, তল্লাশি শুরু হয়েছে।

Advertisement

তবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক কর্তার মতে, ‘‘সামনেই ২০১৬ বিধানসভা ভোট এসে পড়ায় অনুপ্রবেশ কিংবা পাচার বন্ধে রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষ তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির দুষ্কৃতী বিভিন্ন দলের আশ্রয়ে থেকে অবাধে পাচার চালিয়ে যাচ্ছে। যা দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।’’ অতীতেও বিভিন্ন ভোটের আগে অনুপ্রবেশ, পাচার বাড়তে দেখেছেন সীমান্ত এলাকার মানুষ।

বসিরহাট মহকুমায় ডাঙা ও নদীপথ মিলিয়ে ২২১ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা। নদীপথে ১৫৫ কিলোমিটার, বাকিটা স্থলপথ। এর মধ্যে মাত্র ৫০ কিলোমিটার কাঁটাতারে ঘেরা। যার মধ্যে আবার অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বসিরহাট থেকে টাকি, হাসনাবাদ, সামশেরনগর হয়ে একেবারে সমুদ্র-লাগোয়া এলাকা পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার নদীপথ কার্যত দুষ্কৃতীদের ‘মুক্তাঞ্চলে’ পরিণত হওয়ায় সেখানকার বিহারী খাল, চাগাকাপুরগঞ্চ, ভুরকুন্ডা খাল এবং সমুদ্রের মোহনায় এস চুরি পয়েন্ট-সহ ইছামতী, কালিন্দী, হাড়ভাঙা, রায়মঙ্গল, নদীগুলিতে পাহারায় রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জাহাজ। আছে ভাসমান আউটপোস্ট। একাধিক স্পিড বোড। কিন্তু তারপরেও বাড়ছে গরু পাচার, অনুপ্রবেশও।

Advertisement

বসিরহাট মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, স্বরূপনগর থেকে সামশেরনগর পর্যন্ত জঙ্গলের গা বরাবর বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ এবং পাচার চলত দীর্ঘদিন ধরেই। কেন্দ্রে নতুন সরকার আসার পরে গত কয়েক মাসে সীমান্তরক্ষীদের তৎপরতা বাড়ে। তাতে অনেকটা ভাটা পড়েছিল পাচার ও অনুপ্রবেশে। কিন্তু কিছু দিন ধরে তা ফের রমরমিয়ে শুরু হয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, গরু পাচারের কাজে যুক্ত হওয়া এক শ্রেণির দুষ্কৃতী রাতের অন্ধকারে সুন্দরবনের জঙ্গল পথ দিয়ে বাংলাদেশে গরু পাচার করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা গরু সন্দেশখালির রামপুর, সরবেড়িয়া হয়ে নদী পথে বড় বড় নৌকা, ট্রলারে তুলে সামশেরনগর হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছাচ্ছে। একই ভাবে ও পার থেকে অবাধে বাংলাদেশিরা এ পারে চলে আসছে। গোয়েন্দারা আরও জেনেছেন, মূলত বাংলাদেশের কৈখালি, শোলখালি গ্রাম থেকে কালিন্দী, ঝিলা, রায়মঙ্গল নদী পার করে বাংলাদেশিদের পারঘুমটি, কুমিরমারি, হেমনগর, দুলদুলি, ধামাখালি-সহ এ পারের গ্রামীণ এলাকায় বিশেষ কয়েকজনের বাড়িতে রেখে দেওয়া হচ্ছে। এরপর সুযোগ বুঝে তাদের মাছের নৌকোয় তুলে ধামাখালি, রামপুর বা সরবেড়িয়ায় আনার পরে বাস, ব্যক্তিগত গাড়িতে করে কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একই ভাবে স্বরূপনগর সীমান্তের সোনাই নদী পার করিয়ে বাংলাদেশিদের এ পারে আনার পরে কলকাতার দিকে পাঠানো হচ্ছে।

নজরে সীমান্ত

• কয়েক মাস আগে সন্দেশখালিতে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। পাচার এখানকার যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিএসএফের পদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন।

• সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার বাংলাদেশে গিয়ে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে সে দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে এসেছেন।

• সীমান্ত সুরক্ষার বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের সংসদীয় স্থায়ী সমিতির প্রতিনিধি কংগ্রেসের সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য ঘোষ, তৃণমূলের কাকলি ঘোষদস্তিদার, ডেরেক ও ব্রায়েন-সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা সাংসদদের একটি দল বসিরহাটের পানিতর সীমান্তে এসেছিলেন সম্প্রতি।

পুলিশ-প্রশাসনের চোখে ধুলো দিতে দুষ্কৃতীরা ছোট গাড়ি ব্যবহার করছে বলেই জেনেছে গোয়েন্দারা। আর সে কারণে সীমান্ত এলাকায় কিছু দিন ধরে ছোট গাড়ির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ছে বলেও জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের দাবি, দু’দেশের মধ্যে অবৈধ পাচারের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশি কুখ্যাত দুষ্কৃতী কিংবা জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্তদের কেউ কেউ যে এ পারে আসছে না, তেমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। অতীতে বহুবার দেখা গিয়েছে, স্বরূপনগরের হাকিমপুর, আমুদিয়া, তারালি, কৈজুড়ি, বসিরহাটের ঘোজাডাঙা, দক্ষিণ ও উত্তরপাড়া, পানিতর, শাঁকচুড়ো, বাদুড়িয়ার সাহেস্থানগর, হাসনাবাদের কাঠাখালি, বরুণহাট, হিঙ্গলগঞ্জ এবং সুন্দরবন এলাকাকে ‘করিডোর’ হিসাবে ব্যবহার করে জঙ্গি অনুপ্রবেশ হয়েছে এ দেশে। সোয়েল জুবের, কান্দাহার কাণ্ডের অন্যতম বেলাল মিঁয়া, করিম লালা-সহ অনেক উগ্রবাদী এই এলাকা থেকেই ধরা পড়েছে। এ ছাড়াও, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধরা পড়া অনেক জঙ্গিকে জেরা করে নানা সময়ে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, তারা ভারতে ঢোকার পথ হিসাবে বসিরহাট সীমান্তকেই বেছে নিয়েছিল।

এই সীমান্ত এলাকার গুরুত্ব বুঝে ইতিমধ্যে সন্দেশখালিতে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। পাচার এখানকার যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় বলে মন্তব্যও করেছিলেন তিনি। এ বিষয়ে বিএসএফের পদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলে গিয়েছিলেন। সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার বাংলাদেশে গিয়ে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে সে দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে এসেছেন। সীমান্ত সুরক্ষার বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের সংসদীয় স্থায়ী সমিতির প্রতিনিধি কংগ্রেসের সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য ঘোষ, তৃণমূলের কাকলি ঘোষদস্তিদার, ডেরেক ও ব্রায়েন-সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা সাংসদদের একটি দল বসিরহাটের পানিতর সীমান্তে ঘুরে যান সম্প্রতি। প্রদীপবাবু সীমান্ত সুরক্ষা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে রিপোর্ট দিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন।

এরপরে ধামাখালি থেকে বাসন্তী রোড হয়ে কলকাতা যাওয়ার রাস্তায় মিনাখাঁ, ভাঙড় এবং কেএলসি থানা এলাকায় গাড়ি তল্লাশি শুরু হয়েছিল। স্বরূপনগর হয়ে বাদুড়িয়া, বসিরহাট, হাসনাবাদ যাওয়ার রাস্তাগুলিতেও পুলিশ গাড়ি তল্লাশি শুরু করে। কিন্তু এত সবের পরেও গরু, সোনা, কাপড় পাচার কিংবা অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যাচ্ছে না। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, সীমান্তে বিএসএফের তৎপরতা বাড়ানো সত্ত্বেও গত এক বছরে কেবলমাত্র স্বরূপনগর সীমান্তে পাচারে বাধা দিতে গিয়ে ৩ জন বিএসএফ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। অন্তত ২০ জন সীমান্তরক্ষী আহত হয়েছে পাচারকারীদের হামলায়। হাকিমপুর-সহ সীমান্ত এলাকার কয়েকটি বিএসএফ চৌকি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১০ কোটি টাকার কাপড় ও সোনার বিস্কুট উদ্ধারের পাশাপাশি ৩০ জন পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু গত ৩-৪ মাসেই ধরা পড়েছে শতাধিক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। গরুপাচারের আড়ালে বাড়ছে অনুপ্রবেশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement