বেহাল শ্মশান। ছবি: দিলীপ নস্কর।
শ্মশানের এক ধারে কাঠের চিতা সাজাতে সাজাতে দর দর করে ঘামছিলেন ভুবন কয়াল। মাঝে মাঝে কোমরে বাঁধা গামছা দিয়ে ঘাম মুছছিলেন। বিড় বিড় করতে বললেন, ‘‘এ ভাবে কী আর কাজ করা যায়। চিতা সাজানো থেকে শুরু করে দাহ করা পর্যন্ত গোটাটাই এই রোদ মাথায় নিয়ে করতে হবে! আমাদের ভোগান্তি, মানুষের মরেও শান্তি নেই!’’
জয়নগর ২ ব্লকের ঝিঙাখালি গ্রামের কাছে মঙ্গলতীর্থ মহাশ্মশানের পরিকাঠামোর জন্য বছরের পর বছর চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় শবযাত্রীদের।
ওই ব্লকের নলগোড়া পঞ্চায়েতে ঝিঙেখালি গ্রামের পাশে ওই শ্মশানটি প্রায় ৪০-৪৫ বছরের পুরনো। পুকুর-সহ প্রায় আড়াই বিঘা জমির উপরে শ্মশান। সৎকারের জন্য আসেন নলগেড়া পঞ্চায়েত-সহ চুপড়িজাড়া, মণিরতট পঞ্চায়েতের ৩০-৩৫টি গ্রামের মানুষ। সারা মাসে গড়ে ১০-১৫টি দাহ হয়।
জানা গেল, শ্মশানের এক-দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কোনও খাবারের দোকান নেই। দাহ করার কাঠ নিয়ে আসতে হয় বাড়ি থেকে। পানীয় জলের নলকূপ নেই বললেই চলে। একটা নলকূপ প্রায় সারা বছর খারাপ হয়ে পড়ে থাকে। ফলে পানীয় জলের সমস্যা প্রকট। গরম কালে ভোগান্তি চরমে ওঠে। চিতার আগুন নেভানোর জলটুকু পর্যন্ত মেলে না কখনও সখনও। একটি মাত্র পুকুরের জলই সব কাজে ব্যবহার করতে হয়। গরমের সময় পুকুর শুকিয়ে গেলে কার্যত হাতে হ্যারিকেন!
শ্মশানের ভাঙাচোরা ছাউনি যে কোনও মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ হয়নি। সন্ধে নামলেই অন্ধকারে ঢেকে যায় গোটা চত্বর। রাতে দাহ করতে গেলে ভ্যানে চাপিয়ে ভাড়া করা জেনারেটর বা ইর্মাজেন্সি লাইট আসেন শবযাত্রীরা।
শৌচাগারটুকু নেই শ্মশানে। পুরুষেরা কোনও মতে কাজ চালিয়ে নিলেও মহিলারা পড়েন মহা সমস্যা। শ্মশানে পুরোহিত নেই। শবদাহ করার আগে মন্ত্রপাঠ, ধার্মিক ক্রিয়া-কর্ম করতে হলে পুরোহিতকে দিয়ে লিখিয়ে আনা চিরকুট পড়ে কাজ চালাতে হয়!
ছাউনি না থাকায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে চিতার আগুন পর্যন্ত নিভে যায়। আধপোড়া দেহ কখনও সখনও জলে ভেসেও যায়। আবার বৃষ্টি থামলে নতুন করে ফের চিতা সাজিয়ে দাহ করার কাজ শুরু করতে হয়।
বছর দু’য়েক আগে পর্যন্ত মৃতের শংসাপত্র ছাড়াই দাহ করা হতো এখানে। বর্তমানে অবশ্য এমন বেনিয়ম দেখা যায় না। ‘মঙ্গলতীর্থ মহাশ্মশান কমিটি’র সদস্যেরা হাজির থাকেন। দাহ করতে এলে শংসাপত্র দেখতে চাওয়া হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা অবনী পাইকের অভিযোগ, ‘‘গ্রামে কেউ মারা গেলে দেহ আনা হয় এখানেই। বছর দ’শেক ধরে এই কাজ করছি। দিনের আলোতে দেহ আনলে তবু স্বস্তি। রাতে কেউ মারা গেলে দেহ নিয়ে আসা থেকে শবদাহ করা পর্যন্ত ভোগান্তির শেষ থাকে না। শ্মশান চত্বরে আলোই তো নেই। যাতায়াতের রাস্তাটুকুও ঘন অন্ধকারে ডুবে থাকে।’’ অবনীবাবুর অভিজ্ঞতায়, ‘‘একবার বৃষ্টির রাতে একই পলিথিনে শবদেহের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কাটিয়েছিলেন আমরা শবযাত্রীরা। সে এক গা শিরশিরে কাণ্ড!’’ ঘটিহারানিয়া এলাকার বাসিন্দা শঙ্কর বর জানালেন, কাছাকাছি অন্য কোনও শ্মশান না থাকায় বাধ্য হয়ে এখানেই যেতে হয়।
শ্মশান কমিটির সম্পাদক মানবেন্দ্রনাথ গায়েন বলেন, ‘‘শ্মশানের পরিকাঠামো ঠিকঠাক না থাকায় প্রতিনিয়ত শবযাত্রীদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হচ্ছে। সমস্ত বিষয়ে এলাকার পঞ্চায়েতের প্রধানকে বলা হয়েছিল। পঞ্চায়েত থেকে পুকুর সংস্কার করা হয়েছিল।’’ কিন্তু সেটুকুরই যথেষ্ট নয় বলে জানালেন তিনি।