প্রতীকী ছবি
মদনটাক, কাদাচোরা, শামুকখোল, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, টিয়া, বুলবুল— কোথায় ছিল এরা এত দিন? ইদদানীং তারা ঘন ঘনই চোখে পড়ছে সুন্দরবনে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে পাখিদের কলকাকলিতে মুগ্ধ মানুষজন। সকলেই বলছেন, বহু বছর বাদে ফিরে এসেছে এই পরিবেশ।
লকডাউনের জেরে পর্যটন ব্যবসা বন্ধ। বন্ধ খেয়া পারাপার। সুন্দরবনের নদী, খাঁড়িগুলিতে চলছে না লঞ্চ বা ভুটভুটি। কার্যত এই সময় একেবারে শান্ত সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ। গত দেড় মাসে দূষণও অনেকখানি কমেছে। এই শান্ত-মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ পেয়ে এলাকায় ফিরছে প্রচুর পাখি।
গত কয়েক দিন ধরেই সুন্দরবনের দয়াপুর, পাখিরালয়, সাতজেলিয়া, চুনাখালি, পিয়ালি, ঝড়খালি এলাকায় প্রচুর পাখির দেখা পাওয়া যাচ্ছে। মূলত শীতকালে সুন্দরবনে এলে বিভিন্ন ধরনের পাখির দেখা মেলে। এ বার শীত চলে গেলেও চৈত্র-বৈশাখের গরম তেমমন অনুভূত হয়নি। মাঝে মধ্যে কালবৈশাখীর ঝড়-বৃষ্টি স্বস্তি দিয়েছে। আপাতত সুন্দরবনের জল-জঙ্গলে না আছে মানুষের হাঁকডাক, না আছে পেট্রল-ডিজেল পোড়ার দূষণ। গাছ কাটার খবরও নেই গত দেড় মাসে।
এখন সুন্দরবনের বহু এলাকা পাখিদের কলতানে মুখরিত হয়ে থাকছে। ইতিমধ্যেই সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী তীর ও লোকালয়ের কাছে যে ঝোপঝাড় রয়েছে সেখানে দেখা মিলছে মদনটাক, কাদাচোরা, শামুকখোল, নানা প্রজাতির বক, বিভিন্ন ধরনের মাছরাঙা, পানকৌড়ি, টিয়া, বুলবুলি-সহ আরও অনেক পাখিদের।
এক সময়ে পাখিদের আনাগোনা এখানে এত বেশি ছিল যে সুন্দরবনের সজনেখালি অভয়ারণ্যের ঠিক উল্টোদিকের গ্রামের নাম হয়ে উঠেছিল পাখিরালয়। কিন্তু বহু বছর ধরে সেখানে পাখিদের আনাগোনা নেই বললেই চলে।
একের পর এক গজিয়ে ওঠা হোটেল ও পর্যটক, লঞ্চ, ভুটভুটির হই-হট্টগোলে পাখিরা এখানে আসতেই ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু লকডাউনের ফলে এই এলাকায় আবার সকাল, বিকেল, সন্ধ্যায় প্রচুর পাখিদের আনাগোনা বেড়েছে বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।
এলাকার বাসিন্দা সন্দীপ খাটুয়া বলেন, ‘‘এখন প্রতিদিন ভোরে ও বিকেলের দিকে প্রচুর পাখিদের দেখা যাচ্ছে পাখিরালয়ের জঙ্গলে। এখানে এলে পাখিদের কলতানে মন ভাল হয়ে যাচ্ছে।’’ এই একই বক্তব্য চুনাখালির বাসিন্দা স্নেহাশিস বৈরাগীরও। তিনি বলেন, ‘‘বহুদিন পর পাখিরা এই এলাকায় ফিরেছে। তাদের কিচিরমিচিরে চারিদিক মুখরিত হচ্ছে।’’ এ বিষয়ে বিশিষ্ট পাখি-বিশারদ অর্ক সরকার বলেন, ‘‘মূলত পরিযায়ী পাখিরা শীতের শেষে ফিরে যায়। স্থানীয় পাখিদেরও আগের মতো সে ভাবে এখন দেখা যায় না। তবে কোলাহল, শব্দদূষণ কম থাকায় কিছু পাখি হয় তো ফিরেছে। এটা ভাল লক্ষণ। তবে এই পাখিগুলিকে ভাল ভাবে লক্ষ্য করতে হবে। কোন ধরনের পাখিরা ফিরেছে, লকডাউন উঠে গেলেও এরা এলাকায় থাকছে কিনা, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। আসলে ওরা বসবাসের পরিবেশ পেলেই এলাকায় ফিরবে।’’
শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ পেয়ে অনেক জীবজন্তুও বাইরে বেরিয়ে আসছে। দিনে রাতে গোসাপ, গন্ধগকুল, বাঘরোল রাস্তা পার হয়ে এক ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে চলাফেরা করছে। লকডাউন আচমকা উঠে গেলে এই সমস্ত প্রাণীদের পক্ষে বিপদও নেমে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। রাস্তা পারাপার করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় এদের প্রাণনাশেরও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে বলে দাবি তাঁদের।
দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবন এলাকায় বাঘ-সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করছেন জয়দীপ কুণ্ডু। তাঁর কথায়, ‘‘পরিবেশের দূষণ, কোলাহল কমে যাওয়ায় প্রচুর পাখি যেমন এলাকায় ফিরছে তেমনই প্রচুর জীবজন্তুও পথে ঘাটে বেরিয়ে পড়ছে। লকডাউন উঠে গেলে এই সমস্ত জীবজন্তুরা বিপদে পড়ে যাবে। ফলে এখন থেকেই সে বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে।’’