ভোটে জয়লাভ এক বস্তু, আর তিন-চতুর্থাংশ ভোট, ১৪ শতাংশ ভোট-ব্যবধান’সহ জয় আর এক বস্তু। এ যেন এক সুনামি। বিশেষত যখন কোনও রাজ্যে ছয় মাস আগেই জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি বড় ভাবে পরাজিত হয়েছে (১৭-৩০), তার পরই রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বে মহায্যুতি-র এই জয় (২৩০-৪৮) নিশ্চিত ভাবেই বড় খবর। ইতিমধ্যেই একাধিক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন যে ভোটের ফল বিস্ময়কর হওয়া ভারতের মাটিতে আর নতুন কোনও সংবাদ নয়, বহু বার তেমন ঘটতে দেখা গিয়েছে। তবে এই ভাবে লোকসভা ভোটে জাতীয় স্তরের দল পরাজিত হওয়া, আর তার পর বিধানসভা ভোটে আঞ্চলিক দলকে দুরমুশ করে জাতীয় স্তরের সেই দলেরই বিরাট ব্যবধানে জয়লাভ— একে অবশ্যই সুলভ ঘটনা বলা চলে না। উদ্ধব ঠাকরের সরকার মোটের উপর সফল ভাবেই শাসন পরিচালনা করেছিল, বিশেষত কোভিড-কালের কঠিন চ্যালেঞ্জ শক্ত ভাবে সামলেছিল। ঠাকরে-চালিত শিবসেনা, কংগ্রেস ও শরদ পওয়ারের এনসিপি সমন্বিত মহাবিকাশ আঘাড়ী বা এমভিএ যে তবুও এই ভাবে রাজ্যের সর্বত্র মুখ থুবড়ে পড়বে, স্থিতাবস্থা-বিরোধী মানসিকতা যে এই পর্যায়ে যাবে— এ কথা বিজয়ীরাও হয়তো ভাবেননি। বিজেপির এই বিপুল কৃতিত্বের পর স্বভাবতই মহায্যুতির অন্য শরিকরা এখন ম্লান, একনাথ শিন্দে তদারকি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কাজ চালালেও দেবেন্দ্র ফডণবীস মুখ্যমন্ত্রীর আসনের দাবিতে এগিয়ে গেলেন। প্রয়োজনে জোট রাজনীতির ব্যাকরণ কী ভাবে পেশিজোরে বিকৃত করা যায় বিজেপি ইতিমধ্যেই তা ভাল ভাবে অধ্যয়ন করেছে। তবে মহারাষ্ট্র যে সংখ্যার আসনখানি বিজেপির পথের ধারে পেতে দিয়েছে, তাতে কোনও জোরেরই দরকার হল না।
লক্ষণীয়, কী ভাবে শহর-গ্রাম, উচ্চজাতি-নিম্নবর্ণ, কিংবা আঞ্চলিক বিভিন্নতা সমস্ত পেরিয়ে গিয়েছে মহায্যুতির এ বারের ভোটদাপট। সন্দেহ নেই, এমভিএ-র তরফে বিপজ্জনক আত্মসন্তুষ্টি এবং আলগা প্রচার দেখা গিয়েছে আগাগোড়া। উল্টো দিকে, আরএসএস-এর উগ্র প্রচার বুঝিয়ে দিয়েছে, লোকসভার ভোটের অভিজ্ঞতার পর আর এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি নয় হিন্দুত্ব পক্ষ। লোকসভা ভোটের সময় আরএসএস নানা কারণেই সম্পূর্ণ শক্তিতে প্রচার করতে নামেনি, পরবর্তী সময়ে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠক ও আলোচনায় দুই পক্ষের মধ্যেকার অন্ধকার অনেকটাই কেটেছে। হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্র, দুই ভোটই বুঝিয়ে দিল, কারণ যা-ই হোক না কেন, আরএসএস দৃঢ় ভাবে মোদী-চালিত বিজেপির পাশে থাকলে দেশের খুব কম অঞ্চলই সেই হিন্দুত্ব-মেরুর আকর্ষণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে। অবশ্যই হিন্দুত্বের সঙ্গে সুকৌশলে যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক মরাঠা আবেগও, একাধারে শিবাজি এবং সাভারকরের ‘উত্তরাধিকার’ প্রচার।
কোন কোন বিষয় হেরে গেল হিন্দুত্ব আবেগের সুনামির সামনে? জাতগণনার দাবি তুলেছিল কংগ্রেস, সহজেই বিজেপি নিজেরাই জাতগণনার প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করে তার মোকাবিলা করেছে। এ বছর ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রের যুগ্ম ভোটের ঋতুতে বিজেপি যে ভাবে জাতগণনা প্রসঙ্গটি ফিরিয়ে এনে নিজেদের ঝুলিতে যথাযোগ্য প্রাপ্তি ভরে নিতে পারল, রাজনীতি-কৌশল হিসাবে তা দর্শনীয়, বিরোধীদের কাছে ঈর্ষণীয়ও বটে। রাহুল গান্ধীর ‘সংবিধান বিপন্ন’ প্রচার শেষ অবধি ম্লান হয়ে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহের উগ্র ভাবে ‘আকর্ষক’ মুসলমান-বিদ্বেষ তাসের সামনে। গত লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরে এলেও শরিকদের সামনে এত দিন নত থেকেছেন। বোঝাই যায় মহারাষ্ট্র সেই সমীকরণ এ বার উল্টে দিল। এখন আবার সময় হল— উদ্ধত সংখ্যাগুরুবাদের দুয়ার খুলে হিন্দুত্ব ৩.০ নামক অশ্বমেধের ঘোড়াটি সবলে ছোটানোর জন্য জমি প্রস্তুত।